ঢাকা ০২:০৩ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৭ অক্টোবর ২০২৫, ২ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি—মিশর থেকে বাংলাদেশ: এক জাতির গণতন্ত্রের দুঃস্বপ্ন

আবু আজওয়াদ আহমাদ হাশেমী
আবু আজওয়াদ আহমাদ হাশেমী
  • আপলোড সময় : ০৮:২২:০১ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২২ মে ২০২৫
  • / ৩৫৪ বার পড়া হয়েছে

ইতিহাস আমাদের শেখায়, আবার অনেক সময় ইতিহাস নীরবে নিজের পুনরাবৃত্তি ঘটায়। একটি রাষ্ট্রে দীর্ঘ সময় ধরে চলা স্বৈরশাসনের পতনের পর যদি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েও রাজনৈতিক পরিপক্বতা, সহনশীলতা ও বাস্তবতাবোধের অভাব থাকে, তবে সেই গণতন্ত্র টেকে না। মিশরের রাজনৈতিক ইতিহাস তার জ্বলন্ত উদাহরণ—যার প্রতিচ্ছবি এখন বাংলাদেশের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে দৃশ্যমান হয়ে উঠছে।

মিশরের ঘটনাপ্রবাহ: গণতন্ত্রের স্বপ্নভঙ্গ
তিন দশক ধরে হোসনি মোবারকের শাসনকালে মিশর হয়ে উঠেছিল এক নিপীড়নের রাষ্ট্র।
“কথা বললে গ্রেপ্তার, প্রতিবাদ করলে গুম, রাজপথে নামলে গুলি”—এই ছিল রাষ্ট্রযন্ত্রের চেহারা।

২০১১ সালে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে মোবারকের পতন ঘটে। জনগণের প্রত্যাশায় গড়ে ওঠে নতুন এক গণতান্ত্রিক সূর্যোদয়—ক্ষমতায় আসেন মুসলিম ব্রাদারহুডের সমর্থিত মোহাম্মদ মুরসি। কিন্তু প্রথমবারের মতো প্রাপ্ত স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের স্বাদ যেন রাজনৈতিক দল ও জনগণ সামলাতে পারেনি। সংবিধান, আদর্শ, নীতি নিয়ে শুরু হয় একে অপরের বিরুদ্ধে দাবির স্রোত। ডান-বামের দ্বন্দ্বে এক সময় বামপন্থিরাই আওয়াজ তোলে—“মুরসিকেই চাই না!”

এ সুযোগ কাজে লাগায় ইসরাইল, সৌদি আরবসহ মুরসি-বিরোধী অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তি। ফলাফল: ২০১৩ সালে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের মাধ্যমে গণতন্ত্রের পরিসমাপ্তি এবং ক্ষমতা দখল করেন সেনাপ্রধান জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি। শুরু হয় আরও কঠোর, আরও ভয়ংকর স্বৈরতন্ত্র।

মুরসির সমর্থকদের ওপর নেমে আসে হত্যাযজ্ঞ। বামপন্থিরাও সিসির দমননীতির হাত থেকে রক্ষা পায়নি। হোসনি মোবারক জেল থেকে মুক্ত হয়ে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় মৃত্যু বরণ করেন। পূর্বের স্বৈরাচারীরা রাষ্ট্রীয় পুরস্কার ও সম্মানে ভূষিত হন, আর গণতন্ত্রের জন্য লড়াকুরা হয় কারাবন্দি, প্রবাসী অথবা নীরব।

বাংলাদেশ: একই পথের পথিক?
বাংলাদেশে ২০০৯ সাল থেকে চলমান ক্ষমতাসীন সরকারের শাসনব্যবস্থা অনেকটাই হোসনি মোবারকের শাসনের মতো হয়ে উঠেছে বলে বিশ্লেষকদের মত। গত ১৬ বছরে বিরোধী দল—বিএনপি, জামায়াত, ডান-বাম সকলের প্রতি দমন-পীড়ন, গুম, খুন, মামলা ও রাজনৈতিক হয়রানি যেন রাষ্ট্রীয় নীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তবে ইতিহাস বলে, প্রতিটি স্বৈরাচারের পতন অনিবার্য। এই পরিবর্তনের সম্ভাব্য প্রতীক হয়ে উঠছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস—যাঁর জনপ্রিয়তা, আন্তর্জাতিক অবস্থান এবং সাম্প্রতিক আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে তাঁকে তুলনা করা যেতে পারে মিশরের মোহাম্মদ মুরসির সঙ্গে।

কিন্তু সমস্যা এখানেই। গণতন্ত্র ফিরে পেয়ে রাজনৈতিক দলগুলো আবারও চাহিদার পাহাড় দাঁড় করাচ্ছে—এই সংবিধান চাই, ঐ নির্বাচন চাই, এই দল বাদ, ঐ নেতা চাই। একদিকে রাজনৈতিক দাবি, অন্যদিকে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের চাপ, করিডোর ইস্যু, নারী সংস্কারসহ নানা বিতর্কে ইউনূসের সরকারকে প্রতিনিয়ত বিপাকে ফেলা হচ্ছে।

বিএনপি ও অন্যান্য দলগুলোর অহেতুক আন্দোলন, অহিংস পথে না গিয়ে হঠকারী রাজনীতি এবং অবিরাম দাবি-দাওয়ার রাজনীতি বর্তমান গণতন্ত্রকে আবারও হুমকির মুখে ফেলছে। সব মিলিয়ে আশঙ্কা করা হচ্ছে—একদিন হঠাৎ করেই ঘোষণা আসবে: “ড. ইউনূস আউট!” ঠিক যেভাবে মিশরের গণতন্ত্রের ওপর বাজ পড়েছিল।

ভবিষ্যতের প্রতিচ্ছবি: নতুন সিসির আবির্ভাব?
ড. ইউনূসের পতনের পর, যদি রাষ্ট্রীয় শূন্যতা সৃষ্টি হয়, তবে সম্ভাবনা রয়েছে—কোনো সেনাশক্তি বা আধাসামরিক বাহিনী নতুন করে ক্ষমতায় আসবে। তাঁরাই হবে নতুন “সিসি”—যিনি হয়তো হোসনি মোবারকের চেয়েও কঠোর হবেন।

তখন শুরু হবে গণতন্ত্রকামীদের বিরুদ্ধে ভয়াবহ প্রতিহিংসা। ২০২৪ সালের আন্দোলনে অংশ নেওয়া হাজারো তরুণ-তরুণী হবে বন্দি, গুম, বা নির্বাসিত। তখন রাষ্ট্র হবে নিঃস্ব, আর জনগণের কণ্ঠ হবে নির্বাক।

উপসংহার: আত্মসমালোচনার প্রয়োজন
বাংলাদেশের রাজনীতি আজ একটি সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। একদিকে আছে গণতন্ত্রের আশাবাদ, অন্যদিকে আছে ইতিহাসের নিষ্ঠুর পুনরাবৃত্তির সম্ভাবনা। রাষ্ট্রযন্ত্র ও রাজনৈতিক দলগুলো যদি দায়িত্বশীল না হয়, ক্ষমতার লোভে অন্ধ না হয়, আর জনগণ যদি বিভক্তির রাজনীতি পরিহার করে বাস্তববাদী ও যুক্তিসঙ্গত অবস্থান না নেয়—তবে আমাদের ভবিষ্যৎ আরও অন্ধকার, আরও দুঃসহ হতে বাধ্য।

দেশপ্রেমিক হলে বিপদে পড়তে হবে—এমন বাস্তবতা কোনো রাষ্ট্রের জন্য কাম্য হতে পারে না। তাই এখনই সময়, সবাই মিলে এই জাতির ভবিষ্যৎ রক্ষার জন্য আত্মসমালোচনা, সংলাপ এবং সহনশীলতার পথে ফিরে আসার।

সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করুন

ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি—মিশর থেকে বাংলাদেশ: এক জাতির গণতন্ত্রের দুঃস্বপ্ন

আপলোড সময় : ০৮:২২:০১ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২২ মে ২০২৫

ইতিহাস আমাদের শেখায়, আবার অনেক সময় ইতিহাস নীরবে নিজের পুনরাবৃত্তি ঘটায়। একটি রাষ্ট্রে দীর্ঘ সময় ধরে চলা স্বৈরশাসনের পতনের পর যদি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েও রাজনৈতিক পরিপক্বতা, সহনশীলতা ও বাস্তবতাবোধের অভাব থাকে, তবে সেই গণতন্ত্র টেকে না। মিশরের রাজনৈতিক ইতিহাস তার জ্বলন্ত উদাহরণ—যার প্রতিচ্ছবি এখন বাংলাদেশের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে দৃশ্যমান হয়ে উঠছে।

মিশরের ঘটনাপ্রবাহ: গণতন্ত্রের স্বপ্নভঙ্গ
তিন দশক ধরে হোসনি মোবারকের শাসনকালে মিশর হয়ে উঠেছিল এক নিপীড়নের রাষ্ট্র।
“কথা বললে গ্রেপ্তার, প্রতিবাদ করলে গুম, রাজপথে নামলে গুলি”—এই ছিল রাষ্ট্রযন্ত্রের চেহারা।

২০১১ সালে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে মোবারকের পতন ঘটে। জনগণের প্রত্যাশায় গড়ে ওঠে নতুন এক গণতান্ত্রিক সূর্যোদয়—ক্ষমতায় আসেন মুসলিম ব্রাদারহুডের সমর্থিত মোহাম্মদ মুরসি। কিন্তু প্রথমবারের মতো প্রাপ্ত স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের স্বাদ যেন রাজনৈতিক দল ও জনগণ সামলাতে পারেনি। সংবিধান, আদর্শ, নীতি নিয়ে শুরু হয় একে অপরের বিরুদ্ধে দাবির স্রোত। ডান-বামের দ্বন্দ্বে এক সময় বামপন্থিরাই আওয়াজ তোলে—“মুরসিকেই চাই না!”

এ সুযোগ কাজে লাগায় ইসরাইল, সৌদি আরবসহ মুরসি-বিরোধী অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তি। ফলাফল: ২০১৩ সালে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের মাধ্যমে গণতন্ত্রের পরিসমাপ্তি এবং ক্ষমতা দখল করেন সেনাপ্রধান জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি। শুরু হয় আরও কঠোর, আরও ভয়ংকর স্বৈরতন্ত্র।

মুরসির সমর্থকদের ওপর নেমে আসে হত্যাযজ্ঞ। বামপন্থিরাও সিসির দমননীতির হাত থেকে রক্ষা পায়নি। হোসনি মোবারক জেল থেকে মুক্ত হয়ে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় মৃত্যু বরণ করেন। পূর্বের স্বৈরাচারীরা রাষ্ট্রীয় পুরস্কার ও সম্মানে ভূষিত হন, আর গণতন্ত্রের জন্য লড়াকুরা হয় কারাবন্দি, প্রবাসী অথবা নীরব।

বাংলাদেশ: একই পথের পথিক?
বাংলাদেশে ২০০৯ সাল থেকে চলমান ক্ষমতাসীন সরকারের শাসনব্যবস্থা অনেকটাই হোসনি মোবারকের শাসনের মতো হয়ে উঠেছে বলে বিশ্লেষকদের মত। গত ১৬ বছরে বিরোধী দল—বিএনপি, জামায়াত, ডান-বাম সকলের প্রতি দমন-পীড়ন, গুম, খুন, মামলা ও রাজনৈতিক হয়রানি যেন রাষ্ট্রীয় নীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তবে ইতিহাস বলে, প্রতিটি স্বৈরাচারের পতন অনিবার্য। এই পরিবর্তনের সম্ভাব্য প্রতীক হয়ে উঠছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস—যাঁর জনপ্রিয়তা, আন্তর্জাতিক অবস্থান এবং সাম্প্রতিক আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে তাঁকে তুলনা করা যেতে পারে মিশরের মোহাম্মদ মুরসির সঙ্গে।

কিন্তু সমস্যা এখানেই। গণতন্ত্র ফিরে পেয়ে রাজনৈতিক দলগুলো আবারও চাহিদার পাহাড় দাঁড় করাচ্ছে—এই সংবিধান চাই, ঐ নির্বাচন চাই, এই দল বাদ, ঐ নেতা চাই। একদিকে রাজনৈতিক দাবি, অন্যদিকে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের চাপ, করিডোর ইস্যু, নারী সংস্কারসহ নানা বিতর্কে ইউনূসের সরকারকে প্রতিনিয়ত বিপাকে ফেলা হচ্ছে।

বিএনপি ও অন্যান্য দলগুলোর অহেতুক আন্দোলন, অহিংস পথে না গিয়ে হঠকারী রাজনীতি এবং অবিরাম দাবি-দাওয়ার রাজনীতি বর্তমান গণতন্ত্রকে আবারও হুমকির মুখে ফেলছে। সব মিলিয়ে আশঙ্কা করা হচ্ছে—একদিন হঠাৎ করেই ঘোষণা আসবে: “ড. ইউনূস আউট!” ঠিক যেভাবে মিশরের গণতন্ত্রের ওপর বাজ পড়েছিল।

ভবিষ্যতের প্রতিচ্ছবি: নতুন সিসির আবির্ভাব?
ড. ইউনূসের পতনের পর, যদি রাষ্ট্রীয় শূন্যতা সৃষ্টি হয়, তবে সম্ভাবনা রয়েছে—কোনো সেনাশক্তি বা আধাসামরিক বাহিনী নতুন করে ক্ষমতায় আসবে। তাঁরাই হবে নতুন “সিসি”—যিনি হয়তো হোসনি মোবারকের চেয়েও কঠোর হবেন।

তখন শুরু হবে গণতন্ত্রকামীদের বিরুদ্ধে ভয়াবহ প্রতিহিংসা। ২০২৪ সালের আন্দোলনে অংশ নেওয়া হাজারো তরুণ-তরুণী হবে বন্দি, গুম, বা নির্বাসিত। তখন রাষ্ট্র হবে নিঃস্ব, আর জনগণের কণ্ঠ হবে নির্বাক।

উপসংহার: আত্মসমালোচনার প্রয়োজন
বাংলাদেশের রাজনীতি আজ একটি সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। একদিকে আছে গণতন্ত্রের আশাবাদ, অন্যদিকে আছে ইতিহাসের নিষ্ঠুর পুনরাবৃত্তির সম্ভাবনা। রাষ্ট্রযন্ত্র ও রাজনৈতিক দলগুলো যদি দায়িত্বশীল না হয়, ক্ষমতার লোভে অন্ধ না হয়, আর জনগণ যদি বিভক্তির রাজনীতি পরিহার করে বাস্তববাদী ও যুক্তিসঙ্গত অবস্থান না নেয়—তবে আমাদের ভবিষ্যৎ আরও অন্ধকার, আরও দুঃসহ হতে বাধ্য।

দেশপ্রেমিক হলে বিপদে পড়তে হবে—এমন বাস্তবতা কোনো রাষ্ট্রের জন্য কাম্য হতে পারে না। তাই এখনই সময়, সবাই মিলে এই জাতির ভবিষ্যৎ রক্ষার জন্য আত্মসমালোচনা, সংলাপ এবং সহনশীলতার পথে ফিরে আসার।

সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করুন