ঢাকা ০৬:৪২ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৪ অক্টোবর ২০২৫, ২৯ আশ্বিন ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

কবরের আযাব অস্বীকারকারী ব্যক্তির ইসলামী হুকুম

আবু আজওয়াদ আহমাদ হাশেমী
আবু আজওয়াদ আহমাদ হাশেমী
  • আপলোড সময় : ০২:৪৪:২০ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৭ মে ২০২৫
  • / ৩৩১ বার পড়া হয়েছে

আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আহ-এর বিশ্বাস অনুযায়ী, মৃত্যুর পর মানুষের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায় হলো “বরযখ” বা কবরের জীবন। এ জীবনেও নেককারদের জন্য রহমত ও শান্তি, আর গোনাহগারদের জন্য শাস্তি ও আযাব নির্ধারিত রয়েছে। তবে কিছু ব্যক্তি এই কবরের আযাবকে অস্বীকার করে থাকে। এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো: যদি কেউ কবরের আযাব অস্বীকার করে, তবে সে কি ইসলামী দৃষ্টিতে কাফের গণ্য হবে? এই প্রশ্নের উত্তর কুরআন, হাদীস ও সালাফে সালেহীনের ব্যাখ্যা অনুযায়ী আলোচনা করা হবে।

*প্রথমত: কবরের আযাব সম্পর্কে কুরআনের প্রমাণ*

১. সূরা গাফির: আয়াত ৪৬
قَالَ اللَّهُ تَعَالَى:
“النَّارُ يُعْرَضُونَ عَلَيْهَا غُدُوًّا وَعَشِيًّا ۖ وَيَوْمَ تَقُومُ السَّاعَةُ أَدْخِلُوا آلَ فِرْعَوْنَ أَشَدَّ الْعَذَابِ”
(سورة غافر: ٤٦)

বাংলা অনুবাদ:
“আগুন (জাহান্নাম), যার সামনে তারা (ফিরআউনের পরিবার) সকাল ও সন্ধ্যায় পেশ করা হয়; আর যেদিন কিয়ামত সংঘটিত হবে, সেদিন বলা হবে: ফিরআউনের পরিবারকে কঠিনতম আযাবে নিক্ষেপ করো।”
(সূরা গাফির, আয়াত ৪৬)

তাফসীর: ইবনে কাসীর (রহঃ) বলেন, “এ আয়াত প্রমাণ করে যে মৃত্যুর পর, কিন্তু কিয়ামতের আগে—অর্থাৎ কবরের জীবনে আযাব দেওয়া হয়। এটি ‘আযাবুল-কবর’ এরই অংশ।”
[তাফসীর ইবনে কাসীর, ৭/১২১]

*দ্বিতীয়ত: সহীহ হাদীসে কবরের আযাবের প্রমাণ*

১. সহীহ বুখারী, হাদীস: ১৩৭২
عَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا قَالَتْ:
“دَخَلَتْ عَلَيَّ عَجُوزَانِ مِنْ عَجَائِزِ يَهُودِ الْمَدِينَةِ، فَقَالَتَا: إِنَّ أَهْلَ الْقُبُورِ يُعَذَّبُونَ فِي قُبُورِهِمْ…”
(رواه البخاري، رقم: 1372)

বাংলা অনুবাদ:
“মদীনার দুই বৃদ্ধা ইহুদী মহিলা আমার কাছে এলেন এবং বললেন: নিশ্চয়ই কবরের লোকজনকে তাদের কবরেই আযাব দেওয়া হয়…”
এরপর হাদীসটি দীর্ঘ, যেখানে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কবরের আযাবের সত্যতা নিশ্চিত করেন।

*তৃতীয়ত: সালাফে সালেহীনের বক্তব্য*

১. *ইমাম ত্বহাওয়ী (রহঃ):*
قال الإمام الطحاوي:
“وَنُؤْمِنُ بِعَذَابِ الْقَبْرِ لِمَنْ كَانَ لَهُ أَهْلًا”
(العقيدة الطحاوية)

বাংলা অনুবাদ:
“আমরা কবরের আযাবের প্রতি ঈমান রাখি, যাদের জন্য তা উপযুক্ত।”
এ বক্তব্য দ্বারা বোঝা যায়, কবরের আযাব বিশ্বাস করা ঈমানের একটি অংশ।

২. *ইমাম কুরতুবী (রহঃ):*
قال الإمام القرطبي:
“وقد تظاهرت الأحاديث عن رسول الله صلى الله عليه وسلم في ثبوت عذاب القبر…”
(التذكرة في أحوال الموتى وأمور الآخرة، صـ ١٠٣)

বাংলা অনুবাদ:
“নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট থেকে বহু হাদীস এসেছে, যেগুলোর মাধ্যমে কবরের আযাবের প্রমাণ সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে।”

৩. *ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রহঃ):*
قال ابن تيمية:
“عذاب القبر ونعيمه مما تواترت به الأحاديث عن النبي صلى الله عليه وسلم”
(مجموع الفتاوى، ٤/٢٦٢)

বাংলা অনুবাদ:
“কবরের আযাব ও নেয়ামত এমন একটি বিষয়, যার সম্পর্কে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পক্ষ থেকে হাদীসসমূহ তাওয়াতুর পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।”

*চতুর্থত: যারা কবরের আযাব অস্বীকার করে, তাদের হুকুম কী?*

(ক) *যদি অজ্ঞতাবশত অস্বীকার করে:* সে কাফের নয়।
তবে তাকে শিক্ষা দেওয়া ও হক বুঝানো ওয়াজিব।

(খ) *যদি জেনে-বুঝে, দলীল অস্বীকার করে:* তখন তা “আকীদার মৌলিক বিষয় অস্বীকার” এর পর্যায়ে পড়ে।

কুরআন ও সহীহ হাদীস স্পষ্ট থাকা সত্ত্বেও অস্বীকার করলে কুফরির শঙ্কা প্রবল।

*পঞ্চমত: ফতোয়া ও ওলামায়ে কেরামের সিদ্ধান্ত*

ফাতাওয়া লাজনাহ দায়েমাহ (সৌদি আরব):

“من أنكر عذاب القبر إن كان جاهلاً يعلَّم، وإن أنكر ما هو معلوم من الدين بالضرورة بعد إقامة الحجة عليه يكفر.”
(فتاوى اللجنة الدائمة، ج 1، ص 67)

বাংলা অনুবাদ:
“যদি কেউ কবরের আযাব অস্বীকার করে এবং সে অজ্ঞ হয়, তাহলে তাকে শিক্ষা দিতে হবে। আর যদি কেউ এমন বিষয় অস্বীকার করে যা দ্বীনের আবশ্যক বিষয় হিসেবে পরিচিত এবং তাকে দলীল পেশ করেও বোঝানো হয়, তবুও অস্বীকার করে—তাহলে সে কাফের বলে গণ্য হবে।”

*উপসংহার:*
কবরের আযাব বিশ্বাস করা ইসলামী আকীদার একটি অপরিহার্য অংশ। কুরআন, হাদীস ও ইজমা দ্বারা এর সত্যতা প্রমাণিত। কেউ যদি তা অজ্ঞতাবশত অস্বীকার করে, তবে সে কাফের নয়—তবে গোমরাহ ও বিদআতী।
পক্ষান্তরে, কেউ যদি জেনে-বুঝে কুরআন-হাদীসের প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও অস্বীকার করে, তবে সে ইসলামের মৌলিক বিশ্বাস অস্বীকারকারী এবং কুফরির সীমা লঙ্ঘনকারী বলে বিবেচিত হয়।

اللهم ثبتنا على العقيدة الصحيحة ونجنا من البدعة والضلالة. آمين.
وصلى الله على نبينا محمد، وعلى آله وصحبه أجمعين.

সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করুন

কবরের আযাব অস্বীকারকারী ব্যক্তির ইসলামী হুকুম

আপলোড সময় : ০২:৪৪:২০ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৭ মে ২০২৫

আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আহ-এর বিশ্বাস অনুযায়ী, মৃত্যুর পর মানুষের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায় হলো “বরযখ” বা কবরের জীবন। এ জীবনেও নেককারদের জন্য রহমত ও শান্তি, আর গোনাহগারদের জন্য শাস্তি ও আযাব নির্ধারিত রয়েছে। তবে কিছু ব্যক্তি এই কবরের আযাবকে অস্বীকার করে থাকে। এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো: যদি কেউ কবরের আযাব অস্বীকার করে, তবে সে কি ইসলামী দৃষ্টিতে কাফের গণ্য হবে? এই প্রশ্নের উত্তর কুরআন, হাদীস ও সালাফে সালেহীনের ব্যাখ্যা অনুযায়ী আলোচনা করা হবে।

*প্রথমত: কবরের আযাব সম্পর্কে কুরআনের প্রমাণ*

১. সূরা গাফির: আয়াত ৪৬
قَالَ اللَّهُ تَعَالَى:
“النَّارُ يُعْرَضُونَ عَلَيْهَا غُدُوًّا وَعَشِيًّا ۖ وَيَوْمَ تَقُومُ السَّاعَةُ أَدْخِلُوا آلَ فِرْعَوْنَ أَشَدَّ الْعَذَابِ”
(سورة غافر: ٤٦)

বাংলা অনুবাদ:
“আগুন (জাহান্নাম), যার সামনে তারা (ফিরআউনের পরিবার) সকাল ও সন্ধ্যায় পেশ করা হয়; আর যেদিন কিয়ামত সংঘটিত হবে, সেদিন বলা হবে: ফিরআউনের পরিবারকে কঠিনতম আযাবে নিক্ষেপ করো।”
(সূরা গাফির, আয়াত ৪৬)

তাফসীর: ইবনে কাসীর (রহঃ) বলেন, “এ আয়াত প্রমাণ করে যে মৃত্যুর পর, কিন্তু কিয়ামতের আগে—অর্থাৎ কবরের জীবনে আযাব দেওয়া হয়। এটি ‘আযাবুল-কবর’ এরই অংশ।”
[তাফসীর ইবনে কাসীর, ৭/১২১]

*দ্বিতীয়ত: সহীহ হাদীসে কবরের আযাবের প্রমাণ*

১. সহীহ বুখারী, হাদীস: ১৩৭২
عَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا قَالَتْ:
“دَخَلَتْ عَلَيَّ عَجُوزَانِ مِنْ عَجَائِزِ يَهُودِ الْمَدِينَةِ، فَقَالَتَا: إِنَّ أَهْلَ الْقُبُورِ يُعَذَّبُونَ فِي قُبُورِهِمْ…”
(رواه البخاري، رقم: 1372)

বাংলা অনুবাদ:
“মদীনার দুই বৃদ্ধা ইহুদী মহিলা আমার কাছে এলেন এবং বললেন: নিশ্চয়ই কবরের লোকজনকে তাদের কবরেই আযাব দেওয়া হয়…”
এরপর হাদীসটি দীর্ঘ, যেখানে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কবরের আযাবের সত্যতা নিশ্চিত করেন।

*তৃতীয়ত: সালাফে সালেহীনের বক্তব্য*

১. *ইমাম ত্বহাওয়ী (রহঃ):*
قال الإمام الطحاوي:
“وَنُؤْمِنُ بِعَذَابِ الْقَبْرِ لِمَنْ كَانَ لَهُ أَهْلًا”
(العقيدة الطحاوية)

বাংলা অনুবাদ:
“আমরা কবরের আযাবের প্রতি ঈমান রাখি, যাদের জন্য তা উপযুক্ত।”
এ বক্তব্য দ্বারা বোঝা যায়, কবরের আযাব বিশ্বাস করা ঈমানের একটি অংশ।

২. *ইমাম কুরতুবী (রহঃ):*
قال الإمام القرطبي:
“وقد تظاهرت الأحاديث عن رسول الله صلى الله عليه وسلم في ثبوت عذاب القبر…”
(التذكرة في أحوال الموتى وأمور الآخرة، صـ ١٠٣)

বাংলা অনুবাদ:
“নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট থেকে বহু হাদীস এসেছে, যেগুলোর মাধ্যমে কবরের আযাবের প্রমাণ সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে।”

৩. *ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রহঃ):*
قال ابن تيمية:
“عذاب القبر ونعيمه مما تواترت به الأحاديث عن النبي صلى الله عليه وسلم”
(مجموع الفتاوى، ٤/٢٦٢)

বাংলা অনুবাদ:
“কবরের আযাব ও নেয়ামত এমন একটি বিষয়, যার সম্পর্কে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পক্ষ থেকে হাদীসসমূহ তাওয়াতুর পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।”

*চতুর্থত: যারা কবরের আযাব অস্বীকার করে, তাদের হুকুম কী?*

(ক) *যদি অজ্ঞতাবশত অস্বীকার করে:* সে কাফের নয়।
তবে তাকে শিক্ষা দেওয়া ও হক বুঝানো ওয়াজিব।

(খ) *যদি জেনে-বুঝে, দলীল অস্বীকার করে:* তখন তা “আকীদার মৌলিক বিষয় অস্বীকার” এর পর্যায়ে পড়ে।

কুরআন ও সহীহ হাদীস স্পষ্ট থাকা সত্ত্বেও অস্বীকার করলে কুফরির শঙ্কা প্রবল।

*পঞ্চমত: ফতোয়া ও ওলামায়ে কেরামের সিদ্ধান্ত*

ফাতাওয়া লাজনাহ দায়েমাহ (সৌদি আরব):

“من أنكر عذاب القبر إن كان جاهلاً يعلَّم، وإن أنكر ما هو معلوم من الدين بالضرورة بعد إقامة الحجة عليه يكفر.”
(فتاوى اللجنة الدائمة، ج 1، ص 67)

বাংলা অনুবাদ:
“যদি কেউ কবরের আযাব অস্বীকার করে এবং সে অজ্ঞ হয়, তাহলে তাকে শিক্ষা দিতে হবে। আর যদি কেউ এমন বিষয় অস্বীকার করে যা দ্বীনের আবশ্যক বিষয় হিসেবে পরিচিত এবং তাকে দলীল পেশ করেও বোঝানো হয়, তবুও অস্বীকার করে—তাহলে সে কাফের বলে গণ্য হবে।”

*উপসংহার:*
কবরের আযাব বিশ্বাস করা ইসলামী আকীদার একটি অপরিহার্য অংশ। কুরআন, হাদীস ও ইজমা দ্বারা এর সত্যতা প্রমাণিত। কেউ যদি তা অজ্ঞতাবশত অস্বীকার করে, তবে সে কাফের নয়—তবে গোমরাহ ও বিদআতী।
পক্ষান্তরে, কেউ যদি জেনে-বুঝে কুরআন-হাদীসের প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও অস্বীকার করে, তবে সে ইসলামের মৌলিক বিশ্বাস অস্বীকারকারী এবং কুফরির সীমা লঙ্ঘনকারী বলে বিবেচিত হয়।

اللهم ثبتنا على العقيدة الصحيحة ونجنا من البدعة والضلالة. آمين.
وصلى الله على نبينا محمد، وعلى آله وصحبه أجمعين.

সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করুন