ঢাকা ১১:১০ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৪ অক্টোবর ২০২৫, ২৯ আশ্বিন ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

সদরঘাটের ‘ঘাট সম্রাট’ সুমনের উত্থান – কুলি থেকে কোটি টাকার চাঁদাবাজ!

রনি মজুমদার
রনি মজুমদার
  • আপলোড সময় : ১১:৪৪:৩৮ অপরাহ্ন, শনিবার, ২ অগাস্ট ২০২৫
  • / ১১২২ বার পড়া হয়েছে

অনুসন্ধান প্রতিবেদন: পর্ব – ১
একসময় সদরঘাটের এক কোণে মাথায় গামছা বেঁধে কুলিগিরি করতেন সুমন ভূঁইয়া। আজ সেই মানুষটিই দক্ষিণ ঢাকা ঘাটপাড়ার রাজনীতি, চাঁদাবাজি, দখল, টেন্ডারবাজি এমনকি অপরাধ জগতের ভয়ংকর এক নাম। প্রশ্ন উঠেছে—কার আশীর্বাদে, কার প্রশ্রয়ে এই উত্থান? কীভাবে একজন দিনমজুরের ছেলে হঠাৎ কোটি টাকার ইজারা ও সম্পদের মালিক বনে গেলেন?
সুমনের গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জ। ২০০১ সালে সদরঘাটে কুলি হিসেবে কাজ শুরু করেন। এরপর ২০০৪ সালে ভ্যানচালক থাকা অবস্থায় বিএনপি নেতা নজরুল ইসলাম খানের ঘনিষ্ঠতায় জড়িয়ে পড়েন শ্রমিক রাজনীতিতে। রাজনৈতিক আশীর্বাদ তাকে অল্প সময়েই ২০১০ সালে ঘাট শ্রমিক দলের সাধারণ সম্পাদক বানায়। ২০২১ সালে মহানগর দক্ষিণ শ্রমিক দলের আহ্বায়ক পদে বসিয়ে দেয় শ্রমিক দলের একটি অংশ, যখন দলটি তীব্র নেতৃত্ব সংকটে ছিল।
এর পর থেকেই শুরু হয় তার উত্থান ও অপরাধে যুক্ত হওয়ার এক ভয়ঙ্কর অধ্যায়। ২০১২ সালে সোহেল হত্যা মামলায় ১ নম্বর আসামি হন সুমন। কোতোয়ালি থানার সাবেক এসআই শহীদ তদন্তে তার সম্পৃক্ততা উল্লেখ করেন। এরপর কেরানীগঞ্জে দেলোয়ার হত্যা মামলায়ও উঠে আসে তার নাম—৩ নম্বর আসামি। কিন্তু প্রতিবারই অদৃশ্য চাপে মামলা ধামাচাপা পড়ে যায়।
সম্প্রীতি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ঘাট শ্রমিক দল রেজিস্ট্রেশন নাম্বার বি ২০৬৭,
একটি সংগঠনের নামে অফিস খুলে তার ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা, নতুন পন্থায় চাঁদাবাজি করছে বলে অভিযোগ রয়েছে, শ্রম শ্রম মন্ত্রণালয় খোঁজ নিয়ে জানা যায় এই রেজিস্ট্রেশনে নাম্বারে কোন বৈধ সংগঠন নেই , যেটি ছিল তা অনেক আগেই দুর্নীতির কারণে স্থগিত করা হয়েছে,
বর্তমানে সদরঘাট ও আশেপাশের ঘাট, পরিবহন, গুদাম এবং হকার্স মার্কেট থেকে প্রতিদিন গড়ে এক লক্ষ টাকা আদায় হয় সুমনের নেতৃত্বে। যারা নিয়মিত এই চাঁদা দেন, তাদের মধ্যে কেউ কেউ জানান—দিতে না চাইলে ব্যবসা বন্ধ করে দেওয়া হয়, কিংবা লোকজন এসে হুমকি দেয়। জননী হোটেলের মালিক সাদেক এবং মুন্সীগঞ্জের সাবেক চেয়ারম্যান এর কাছ থেকে বড় অংকের টাকা আদায়ের অভিযোগও রয়েছে।
সদরঘাট হকার্স মার্কেটের ৫০৫ নম্বর দোকান, দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের হাসনাবাদে একটি আধুনিক ফ্ল্যাট—সব মিলিয়ে তার নামে কয়েক কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে। অথচ গত ১৭ বছরে তার কোনো বৈধ আয় দেখা যায়নি। যে সুমন এক সময় বাবার সঙ্গে কুলিগিরি করতেন, তিনি এখন ঘাট ইজারা নিয়েছেন মাত্র ৪ কটি ৪৩ লক্ষ টাকায়—যা আগের বছরের তুলনায় অনেক কম। এই টেন্ডার কীভাবে পেলেন? গোপন সূত্র বলছে, পুরো প্রক্রিয়াই ছিল রাজনৈতিক প্রভাব এবং দরদাম দিয়ে নিয়ন্ত্রিত।
সুমনের সঙ্গে কথা বলতে ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি সব অভিযোগ অস্বীকার করেন। বলেন, দোকান তার আগেই ছিল, আর টেন্ডার নিয়ম মেনেই নিয়েছেন। তবে আয়ের উৎস বা সম্পদের বিবরণ জানতে চাওয়া হলে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যান।
তার পাশে রয়েছে কিছু চিহ্নিত সহযোগী। দেলোয়ার, রুহুল আমিন, কাশিয়ার কিরন সোবাহান, যুবদল কর্মী মোস্তফা এবং তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সহযোগী—মাস্টারমাইন্ড নামে পরিচিত এক ব্যক্তি। তারা মিলে সদরঘাটে একটি অঘোষিত সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছে, যেখানে ভয় এবং চাঁদাই মূল নিয়ম।
বিএনপির একাধিক প্রবীণ নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সুমনের ভয়ে তারা কেউ মুখ খুলতে চান না। একজন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নেতা বলেন—ছেলেটিকে আমরা কুলিগিরি করতে দেখেছি, তখনও সে দিন এনে দিন খেত। এখন সে এমন জায়গায় পৌঁছেছে, যেখানে আমরা নিজেরাই কথা বলার সাহস পাই না। কারণ, যে প্রতিবাদ করে, তার বিপদ হয়।
এই রিপোর্ট যখন লেখা হচ্ছে, তখনও অনেক ভুক্তভোগী মামলা করতে ভয় পাচ্ছেন। কেউ কেউ বলেছেন, একবার মামলা করলেও সুমনের লোকজন এসে হুমকি দিয়েছে, মামলা তুলে নিতে বাধ্য করেছে। কিছু মানুষ এমনও আছেন, যারা অভিযোগ করেও চাপের মুখে এখন মুখ বন্ধ করে রেখেছেন।
প্রশ্ন উঠেছে—একজন মানুষ কীভাবে এত অল্প সময়ে এমন অর্থ ও ক্ষমতার মালিক হয়ে উঠল? প্রশাসন, রাজনীতি এবং দুর্বৃত্তায়নের যে ভয়ানক মিলন, তার জীবন্ত প্রতিচ্ছবি যেন সুমনের চরিত্র।
এই প্রতিবেদন লেখার সময় যেসব তথ্য ও সাক্ষ্য সংগ্রহ করা হয়েছে, তা পরবর্তী পর্বে আরও বিস্তারিত তথ্য, দলিল এবং ভুক্তভোগীদের বক্তব্য তুলে ধরা হবে।
সুমন ভূঁইয়ার এই চাঁদাবাজি ও অপরাধের সাম্রাজ্য ভাঙতে না পারলে সদরঘাটের মতো জনবহুল এলাকা শুধু অরাজক নয়, ভয়াবহ অপরাধের ডেরা হয়ে উঠবে—এ হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন স্থানীয়রা।
চলবে…
(পর্ব – ২ দেখতে চোখ রাখুন)

সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করুন

সদরঘাটের ‘ঘাট সম্রাট’ সুমনের উত্থান – কুলি থেকে কোটি টাকার চাঁদাবাজ!

আপলোড সময় : ১১:৪৪:৩৮ অপরাহ্ন, শনিবার, ২ অগাস্ট ২০২৫

অনুসন্ধান প্রতিবেদন: পর্ব – ১
একসময় সদরঘাটের এক কোণে মাথায় গামছা বেঁধে কুলিগিরি করতেন সুমন ভূঁইয়া। আজ সেই মানুষটিই দক্ষিণ ঢাকা ঘাটপাড়ার রাজনীতি, চাঁদাবাজি, দখল, টেন্ডারবাজি এমনকি অপরাধ জগতের ভয়ংকর এক নাম। প্রশ্ন উঠেছে—কার আশীর্বাদে, কার প্রশ্রয়ে এই উত্থান? কীভাবে একজন দিনমজুরের ছেলে হঠাৎ কোটি টাকার ইজারা ও সম্পদের মালিক বনে গেলেন?
সুমনের গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জ। ২০০১ সালে সদরঘাটে কুলি হিসেবে কাজ শুরু করেন। এরপর ২০০৪ সালে ভ্যানচালক থাকা অবস্থায় বিএনপি নেতা নজরুল ইসলাম খানের ঘনিষ্ঠতায় জড়িয়ে পড়েন শ্রমিক রাজনীতিতে। রাজনৈতিক আশীর্বাদ তাকে অল্প সময়েই ২০১০ সালে ঘাট শ্রমিক দলের সাধারণ সম্পাদক বানায়। ২০২১ সালে মহানগর দক্ষিণ শ্রমিক দলের আহ্বায়ক পদে বসিয়ে দেয় শ্রমিক দলের একটি অংশ, যখন দলটি তীব্র নেতৃত্ব সংকটে ছিল।
এর পর থেকেই শুরু হয় তার উত্থান ও অপরাধে যুক্ত হওয়ার এক ভয়ঙ্কর অধ্যায়। ২০১২ সালে সোহেল হত্যা মামলায় ১ নম্বর আসামি হন সুমন। কোতোয়ালি থানার সাবেক এসআই শহীদ তদন্তে তার সম্পৃক্ততা উল্লেখ করেন। এরপর কেরানীগঞ্জে দেলোয়ার হত্যা মামলায়ও উঠে আসে তার নাম—৩ নম্বর আসামি। কিন্তু প্রতিবারই অদৃশ্য চাপে মামলা ধামাচাপা পড়ে যায়।
সম্প্রীতি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ঘাট শ্রমিক দল রেজিস্ট্রেশন নাম্বার বি ২০৬৭,
একটি সংগঠনের নামে অফিস খুলে তার ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা, নতুন পন্থায় চাঁদাবাজি করছে বলে অভিযোগ রয়েছে, শ্রম শ্রম মন্ত্রণালয় খোঁজ নিয়ে জানা যায় এই রেজিস্ট্রেশনে নাম্বারে কোন বৈধ সংগঠন নেই , যেটি ছিল তা অনেক আগেই দুর্নীতির কারণে স্থগিত করা হয়েছে,
বর্তমানে সদরঘাট ও আশেপাশের ঘাট, পরিবহন, গুদাম এবং হকার্স মার্কেট থেকে প্রতিদিন গড়ে এক লক্ষ টাকা আদায় হয় সুমনের নেতৃত্বে। যারা নিয়মিত এই চাঁদা দেন, তাদের মধ্যে কেউ কেউ জানান—দিতে না চাইলে ব্যবসা বন্ধ করে দেওয়া হয়, কিংবা লোকজন এসে হুমকি দেয়। জননী হোটেলের মালিক সাদেক এবং মুন্সীগঞ্জের সাবেক চেয়ারম্যান এর কাছ থেকে বড় অংকের টাকা আদায়ের অভিযোগও রয়েছে।
সদরঘাট হকার্স মার্কেটের ৫০৫ নম্বর দোকান, দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের হাসনাবাদে একটি আধুনিক ফ্ল্যাট—সব মিলিয়ে তার নামে কয়েক কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে। অথচ গত ১৭ বছরে তার কোনো বৈধ আয় দেখা যায়নি। যে সুমন এক সময় বাবার সঙ্গে কুলিগিরি করতেন, তিনি এখন ঘাট ইজারা নিয়েছেন মাত্র ৪ কটি ৪৩ লক্ষ টাকায়—যা আগের বছরের তুলনায় অনেক কম। এই টেন্ডার কীভাবে পেলেন? গোপন সূত্র বলছে, পুরো প্রক্রিয়াই ছিল রাজনৈতিক প্রভাব এবং দরদাম দিয়ে নিয়ন্ত্রিত।
সুমনের সঙ্গে কথা বলতে ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি সব অভিযোগ অস্বীকার করেন। বলেন, দোকান তার আগেই ছিল, আর টেন্ডার নিয়ম মেনেই নিয়েছেন। তবে আয়ের উৎস বা সম্পদের বিবরণ জানতে চাওয়া হলে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যান।
তার পাশে রয়েছে কিছু চিহ্নিত সহযোগী। দেলোয়ার, রুহুল আমিন, কাশিয়ার কিরন সোবাহান, যুবদল কর্মী মোস্তফা এবং তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সহযোগী—মাস্টারমাইন্ড নামে পরিচিত এক ব্যক্তি। তারা মিলে সদরঘাটে একটি অঘোষিত সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছে, যেখানে ভয় এবং চাঁদাই মূল নিয়ম।
বিএনপির একাধিক প্রবীণ নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সুমনের ভয়ে তারা কেউ মুখ খুলতে চান না। একজন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নেতা বলেন—ছেলেটিকে আমরা কুলিগিরি করতে দেখেছি, তখনও সে দিন এনে দিন খেত। এখন সে এমন জায়গায় পৌঁছেছে, যেখানে আমরা নিজেরাই কথা বলার সাহস পাই না। কারণ, যে প্রতিবাদ করে, তার বিপদ হয়।
এই রিপোর্ট যখন লেখা হচ্ছে, তখনও অনেক ভুক্তভোগী মামলা করতে ভয় পাচ্ছেন। কেউ কেউ বলেছেন, একবার মামলা করলেও সুমনের লোকজন এসে হুমকি দিয়েছে, মামলা তুলে নিতে বাধ্য করেছে। কিছু মানুষ এমনও আছেন, যারা অভিযোগ করেও চাপের মুখে এখন মুখ বন্ধ করে রেখেছেন।
প্রশ্ন উঠেছে—একজন মানুষ কীভাবে এত অল্প সময়ে এমন অর্থ ও ক্ষমতার মালিক হয়ে উঠল? প্রশাসন, রাজনীতি এবং দুর্বৃত্তায়নের যে ভয়ানক মিলন, তার জীবন্ত প্রতিচ্ছবি যেন সুমনের চরিত্র।
এই প্রতিবেদন লেখার সময় যেসব তথ্য ও সাক্ষ্য সংগ্রহ করা হয়েছে, তা পরবর্তী পর্বে আরও বিস্তারিত তথ্য, দলিল এবং ভুক্তভোগীদের বক্তব্য তুলে ধরা হবে।
সুমন ভূঁইয়ার এই চাঁদাবাজি ও অপরাধের সাম্রাজ্য ভাঙতে না পারলে সদরঘাটের মতো জনবহুল এলাকা শুধু অরাজক নয়, ভয়াবহ অপরাধের ডেরা হয়ে উঠবে—এ হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন স্থানীয়রা।
চলবে…
(পর্ব – ২ দেখতে চোখ রাখুন)

সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করুন