ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গত ছয় মাসের সাফল্য: একটি পর্যালোচনা

- আপলোড সময় : ০৩:৫৯:১৯ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৫ মার্চ ২০২৫
- / ২৪৬ বার পড়া হয়েছে
বাংলাদেশের রাজনীতি ও অর্থনীতি দীর্ঘদিন ধরে অনিশ্চয়তার এক কঠিন অধ্যায় অতিক্রম করছে। গত এক দশকের দুর্নীতি, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার ফলস্বরূপ দেশ যখন এক গভীর সংকটে নিমজ্জিত, তখন ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তার নেতৃত্বে এই সরকার মাত্র সাত মাসে যেসব গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পন্ন করেছে, সেগুলো ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য হয়ে থাকবে। যদিও আমরা সুযোগ পেলেই তাকে সমালোচনার তীর বিদ্ধ করি, কিন্তু বাস্তবতা হলো— তার নেতৃত্বে নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ বাংলাদেশকে একটি স্থিতিশীল অবস্থার দিকে এগিয়ে নিচ্ছে।
অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা: ঋণ পরিশোধ ও রিজার্ভ বৃদ্ধির নজিরবিহীন সাফল্য
বিগত সরকারগুলোর অব্যবস্থাপনার ফলে বাংলাদেশ বৈদেশিক ঋণের এক কঠিন বোঝার নিচে চাপা পড়েছিল। তবে গত ছয় মাসে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ৬২ হাজার কোটি টাকা ঋণ পরিশোধ করেছে, যা দেশের অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধারের এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
একই সঙ্গে বাংলাদেশের রিজার্ভ ২ হাজার ১৪০ কোটি ডলারে উন্নীত হয়েছে, যা আগের সরকারের সময় মাত্র ১ হাজার ৮০০ কোটি ডলারে নেমে গিয়েছিল। বিশেষজ্ঞদের মতে, রিজার্ভ বৃদ্ধির এই ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী এক বছরের মধ্যে বৈদেশিক লেনদেন ব্যবস্থায় আরও ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে।
এছাড়াও, দেশের রেমিট্যান্স প্রবাহ ১৮.৪৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে, যা গত বছরের তুলনায় ৪ বিলিয়ন ডলার বেশি। বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠানো উৎসাহিত করতে সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের কারণে এই প্রবৃদ্ধি সম্ভব হয়েছে।
দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও খাদ্য নিরাপত্তা:
রমজান আসলেই বাংলাদেশে খাদ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির প্রবণতা দেখা যায়। কিন্তু এবারের রমজানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অত্যন্ত দক্ষতার সাথে বাজার নিয়ন্ত্রণ করেছে, যার ফলে আশঙ্কাজনক মূল্যবৃদ্ধি হয়নি। দেশের সাধারণ মানুষ বিশেষ করে নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণি এই উদ্যোগের সুফল ভোগ করছে।
সরকারি খাদ্য ভর্তুকি ১২ শতাংশ বৃদ্ধি পাওয়ায় নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম স্থিতিশীল রাখতে সহায়তা করেছে। দীর্ঘদিন ধরে চলা লাগামহীন মূল্যস্ফীতি রোধে এটিও একটি কার্যকর পদক্ষেপ।
অর্থনৈতিক অনিয়মের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা:
অতীত সরকারের অর্থনৈতিক কেলেঙ্কারি ও লুটপাটের কারণে দেশের অর্থনীতি প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এই দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছে।
বিশেষ করে, হাসিনা ও তার পরিবারের একাউন্ট থেকে ৬৩৫ কোটি টাকা উদ্ধার করা হয়েছে, যা প্রমাণ করে যে দুর্নীতির বিরুদ্ধে এই সরকারের অবস্থান আপসহীন।
এছাড়াও, আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে)-এর অনিয়মের কারণে ফিফার নিষেধাজ্ঞার শিকার হয়েছিল বাংলাদেশ। বর্তমান সরকারের প্রচেষ্টায় ফিফা এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে, যা দেশের ক্রীড়াক্ষেত্রের জন্য এক বড় অর্জন।
সুশাসন ও প্রশাসনিক সংস্কার:
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শুধু অর্থনীতি নয়, প্রশাসনিক কাঠামোতেও গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এনেছে।
✅ সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩০ থেকে ৩২ বছর করা হয়েছে, যা দেশের তরুণদের জন্য অত্যন্ত ইতিবাচক পদক্ষেপ।
✅ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের দ্বিতীয় শ্রেণীর গেজেটেড কর্মকর্তার মর্যাদা দেওয়া হয়েছে, যা শিক্ষা খাতে বড় ধরনের উন্নতির ইঙ্গিত দেয়।
✅ ধর্ষণের তদন্ত ১৫ দিনের মধ্যে শেষ করা ও বিচার ৯০ দিনের মধ্যে করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, যা বিচার ব্যবস্থার জন্য একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ।
শিক্ষা ও পাঠ্যক্রম সংস্কার:
অতীত সরকারের সময় পাঠ্যপুস্তকগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব এবং হাসিনা পরিবারের প্রশংসাসূচক বিষয়বস্তু সংযোজন করা হয়েছিল। কিন্তু বর্তমান সরকার সেগুলো বাদ দিয়ে বাস্তবসম্মত ও প্রয়োজনীয় জ্ঞানের ভিত্তিতে সিলেবাস পুনর্গঠন করেছে।
আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও কূটনৈতিক সাফল্য:
বর্তমান সরকারের কূটনৈতিক সাফল্যের বড় উদাহরণ হলো জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের বাংলাদেশ সফর। তিনি ঘোষণা করেছেন, আগামী বছর তিনি মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর পর সেখানে গিয়ে তাদের সঙ্গে ইফতার করবেন। এটি রোহিঙ্গা সমস্যার একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি নির্দেশ করে।
সমালোচনার বাইরে যে সত্য:
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিয়ে সমালোচনা করা সহজ, কিন্তু বাস্তবতা হলো— অতীত সরকারের রেখে যাওয়া ধ্বংসপ্রাপ্ত অর্থনীতি ও প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলার মধ্যে দাঁড়িয়ে ড. ইউনূসের নেতৃত্বে এই সরকার যা করেছে, তা সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে।
ড. ইউনূস যদি এই দায়িত্ব গ্রহণ না করতেন, তাহলে তার বিকল্প হিসেবে অন্য কোনো যোগ্য নেতৃত্ব পাওয়া সম্ভব ছিল কি না, সেটাই প্রশ্ন। তিনি একটি ভঙ্গুর রাষ্ট্র ও স্বার্থান্বেষী সমাজকে সুস্থ ধারায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছেন, যা নিঃসন্দেহে কঠিন একটি কাজ।
অতএব, শুধুমাত্র সমালোচনা নয়— এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করাও আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। ইতিহাস তাকে কিভাবে মূল্যায়ন করবে, তা সময়ই বলে দেবে, তবে এখন পর্যন্ত তার নেতৃত্বে নেওয়া কার্যক্রম ভবিষ্যতের জন্য এক ইতিবাচক দৃষ্টান্ত হিসেবে থাকবে।
বাংলাদেশ অবশ্যই তার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবে।