ঢাকা ১২:৩৯ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ক্যাসিনো গুরু সেলিম মিয়াকে নিয়ে আলোচনার ঝড়

নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক
  • আপলোড সময় : ১২:২৬:২২ অপরাহ্ন, সোমবার, ৮ এপ্রিল ২০২৪
  • / ৫৪৮ বার পড়া হয়েছে

দেশের আলোচিত ক্যাসিনো সম্রাট সেলিম মিয়া ওরফে ডন সেলিম হঠাৎ নারায়ণগঞ্জের রুপগঞ্জকে মাদক ও সন্ত্রাসমুক্ত করার ঘোষনা দেওয়ায় তাকে নিয়ে আলোচনার ঝড় বইছে রুপগঞ্জসহ পুরো নারায়ণগঞ্জজুড়ে। যিনি নিজেই মাদক সম্রাট, ক্যাসিনো গুরু, থাই ডন, স্পা ব্যবসায়ী, চাঁদাবাজদের সর্দার হিসেবে দেশের গন্ডি পেরিয়ে বাইরে পরিচিতি পেয়েছেন তিনি কিভাবে রুপগঞ্জকে মাদক,সন্ত্রাসসহ বিভিন্ন অপরাধ মুক্ত করবেন এমন ঘোষনা দেওয়ায় রুপগঞ্জের পাড়া মহল্লায় তাকে নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় উঠেছে।

দেশ-বিদেশে অনলাইন জুয়া (ক্যাসিনো), স্পা ব্যবসা, সীমান্তের পশুর খাটালে চাঁদাবাজি, চোরাচালানসহ নানা অপকর্মের মূল হোতা এই সেলিম মিয়া ওরফে সেলিম প্রধান। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান চলাকালে ২০১৯ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর থাই এয়ারওয়েজের ফ্লাইটে ব্যাংকক যাওয়ার সময় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে সেলিম প্রধানকে আটক করে র‌্যাব-১। পরে গুলশান ও বনানীর বাসা, অফিসে অভিযান চালিয়ে ২৯ লাখ টাকা, বিপুল বিদেশি মদ ও বিভিন্ন দেশের মুদ্রা জব্দ করা হয়। একই সঙ্গে উদ্ধার করা হয় হরিণের চামড়া। ওই দিনই বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনে ছয় মাসের কারাদন্ড দিয়ে সেলিম প্রধানকে কারাগারে পাঠান ভ্রাম্যমাণ আদালত। দুদকের একটি মামলায় আট বছরের সাজা হয় সেলিম প্রধানের। এদিকে, হুট করে রূপগঞ্জে এই ক্যাসিনো সম্রাটের ফিরে আসাকে অশনি সংকেত বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।

অনুসন্ধান ও এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে জানাগেছে, উপজেলার গাউছিয়া মর্তুজাবাদ গ্রামে ১৯৭৩ সালে সেলিম প্রধানের জন্ম। বাবা ‘চাঁন মিয়া ও তার মায়ের নাম সফুরা খাতুন। ১২-১৩ বছর বয়সে ভাইয়ের সঙ্গে জাপান চলে যান তিনি। জাপানে গিয়ে অপরাধ জগতে জড়িয়ে পড়েন তিনি। সেখানে কে-১ ফাইটিং গ্রুপ তৈরি করেন। একসময় ‘জিরো ওয়াত্তা’ নামে এক জাপানি বক্সার ও আন্ডারওয়াল্ডের সদস্যের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক হয়। জাপানে পাসপোর্ট নিয়ে ঝামেলায় জড়িয়ে সেখানকার চিফ ইমিগ্রেশন কর্মকর্তাকে মারধর করেছিলেন সেলিম মিয়া। ওই ঘটনায় দায়ের করা মামলায় জাপানে জেলও খাটেন তিনি। এরপর জাপান থেকে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান সেলিম। সেখানে কিছু দিন থাকার পর দেশে ফেরেন। কিছুদিন পর আবার থাইল্যান্ড যান সেলিম। সেখানে তার একাধিক বাড়ি ও ব্যবসা রয়েছে। এক সময়ের সেলিম মিয়া এখন ডন সেলিম নামে সারাদেশে পরিচিত। তিনি এখন শত কোটি টাকার মালিক। এক যুগ আগেও সেলিম মিয়ার পরিচয় ছিলো শুধু গাউছিলার মর্তুজাবাদ এলাকার চাঁন মিয়ার ছেলে হিসেবে। সময়ের ব্যবধানে এখন তিনি ক্যাসিনো সম্রাট ডন সেলিম প্রধান নামে পরিচিত লাভ করেছেন। সেলিম প্রধানের পৈতৃক বাড়ি এমন জরাজীর্ণ থাকলেও গাউছিয়া থেকে অল্প দূরেই ভুলতা ফ্লাইওভারের শেষ মাথায় সাওঘাট এলাকায় সেলিম প্রধানের সেই আলোচিত ‘জাপান বাংলাদেশ সিকিউরিটি প্রিন্টিং অ্যান্ড পেপারস’ নামের বহুতল প্রতিষ্ঠান। যেখানে ছাপানো হয় বাংলাদেশের সব ব্যাংকের চেক বই, এফডিআরের মতো গুরুত্বপূর্ণ দলিলাদি।

জাপান থাকা অবস্থায় তার প্রিন্টিং প্রেসের ব্যবসা শুরু করেন। জাপানের টোকিওতেও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে কালো তালিকাভুক্ত হন তিনি। জাপান থেকে বহিষ্কার করা হলে তিনি আমেরিকায় চলে যান। সেখানে এক আমেরিকান নাগরিককে বিয়ে করে স্ত্রীকে কাজে লাগিয়ে ফের জাপানে ঢোকার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। তারপর দেশে ফিরে সেলিম প্রধান ওরফে সেলিম মিয়া বিএনপি-জামায়াত আমলে সখ্য গড়ে তোলেন তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু আলোচিত ব্যবসায়ী গিয়াস উদ্দিন আল মামুনের সঙ্গে। হয়ে যান তার ব্যবসায়িক পার্টনার। এলাকাবাসী সেলিম প্রধানকে বিএনপির স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা হিসেবে জানলেও তিনি কোনো পদে ছিলেন না।

সেলিম প্রধানের আপন চাচাতো ভাই আনোয়াদ সাদাত সায়েম জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি হয়েছেন সেলিম প্রধানের হাতের ইশারায়। আনোয়ার সাদাত সায়েম জাপান-বাংলাদেশ সিকিউরিটি প্রিন্টিংয়ের পরিচালক। সেলিম প্রধান যখন এলাকায় আসতেন সঙ্গে থাকত দামি গাড়িবহর, অস্ত্রধারী বডিগার্ড। দেশে ও বিদেশে ক্যাসিনোর পাশাপাশি স্পা ব্যবসা করা সেলিম নিয়মিত আসতেন তার প্রেসে। প্রেসের ভিতরে রয়েছে তার বালাখানা। গভীর রাতে সেলিম মিয়া এখানে আসতেন ঘনিষ্ঠদের নিয়ে। বিদেশি নাগরিকদেরও নিয়ে আসতেন। সঙ্গে থাকতেন সুন্দরী ললনারা। ভোর পর্যন্ত চলত মদ্যপান, হৈহুল্লোড়। র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার হয়েছিলেন সেলিম মিয়া। ব্যাংককের পাতায়ায় তার বিলাসবহুল হোটেল, ডিসকো বারসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। শুধু অনলাইন ক্যাসিনো পরিচালনাই নয়, সেলিম রাজশাহীসহ সীমান্ত এলাকায় ভারতীয় গবাদিপশুর সব খাটাল ও মাদক সিন্ডিকেটের হোতা। এমনকি সীমান্তে জাল টাকার মূল সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণও তার হাতে। গুলশান ২-এর ৯৯ নম্বর সড়কের ১১/১ নম্বর বাসার একটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট ভাড়া করে ‘রংমহল’ বানিয়েছিলেন আন্ডারওয়ার্ল্ডে ‘থাই ডন’ হিসেবে পরিচিত সেলিম প্রধান। সপ্তাহের প্রতি শনিবার বিকেল সাড়ে ৩টা থেকে সারারাত সেখানে ‘জলসা’ হতো। সেই জলসায় যাতায়াত ছিল একাধিক প্রভাবশালী রাজনীতিক, শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারও। জলসায় অংশগ্রহণকারীদের অনৈতিক ও অসংযত জীবনাচরণের ছবি ধারণ করতে বসানো ছিল গোপন ক্যামেরা। সেই ক্যামেরায় ধারণ করা ভিডিও মেমোরি কার্ডে নিয়ে রাখতেন সেলিম মিয়া। পরে ওই ছবি দেখিয়ে ভিআইপিদের ফাঁসানোর ফাঁদ পাততেন তিনি। সেলিমের ঘনিষ্ঠজন ছাড়াও একাধিক দায়িত্বশীল গোয়েন্দা সূত্র থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। র‌্যাবের হাতে গ্রেফতারের পর সেলিম প্রধানের অপরাধ জগতের অনেক চমকপ্রদ তথ্য বেরিয়ে এসেছে।

গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, আন্ডারওয়াল্ডের ডন সেলিম প্রধান ২০১৯ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর থাই এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইটে বিদেশ যাওয়ার সময় তার লাগেজের সঙ্গে অনেক মালপত্র নিয়ে যাচ্ছিলেন। লাগেজ তল্লাশি করে পাওয়া যায় তিনটি মেমোরি কার্ড। পরে ওই কার্ড পরীক্ষা করে দেখা যায়, সেখানে রয়েছে দেশি-বিদেশি তরুণীদের সঙ্গে অনেক ভিআইপির অন্তরঙ্গ ছবি। জিজ্ঞাসাবাদে জানতে চাওয়া হয়, কেন ওই মেমোরি কার্ড থাইল্যান্ডে নিয়ে যাচ্ছিলেন- এ প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি সেলিম মিয়া। তবে গোয়েন্দারা বলেছেন, এসব ভিডিও দেখিয়ে ফাঁসানোর ভয় দেখিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা ছিল সেলিম প্রধানের। বিদেশে বসে ভিআইপিদের গোপন ভিডিও প্রচার ও প্রকাশের কথা বলে টাকা হাতিয়ে নেওয়াই ছিল তার মূল উদ্দেশ্য।

গোয়েন্দারা বলছেন, সেলিম প্রধান একজন বহুরূপী প্রতারক। সমাজের উচ্চবিত্ত শ্রেণির সঙ্গে তার গভীর সখ্য ছিল। অনেক সময় বড় বড় প্রতিষ্ঠান কোনো আইনি ঝামেলায় পড়লে প্রভাবশালীদের ব্যবহার করে তা মিটমাট করে দেওয়ার বিনিময়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়েছেন তিনি। তবে যারা তার রংমহলে নিয়মিত যেতেন তারা কোনোভাবে টের পাননি গোপনে তার ছবি ধারণ করে রাখা হচ্ছে।
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি সংস্থা সেলিমের সহকারী মাসুমকে জিজ্ঞাসাবাদ করায় বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য মিলেছে। তিনি সেলিমের রংমহলের অনেক তথ্য দিয়েছেন। গুলশানে সেলিমের বাসা থেকে অসামাজিক কাজে ব্যবহার হতো, এরকম অনেক আলামত পাওয়া গেছে। মাসুম জানান, সেলিমের নির্দেশে বায়তুল মোকাররম মার্কেট থেকে গোপন ক্যামেরা কিনে গুলশানের বাসায় লাগানো হয়। গোপনে ভিআইপিদের ছবি ধারণ করার দায় সেলিম প্রধানের। গুলশানে তার রংমহলে যারা নিয়মিত যেতেন তাদের ‘প্রধান ক্লাবের’ সদস্য করে নিতেন সেলিম। ‘প্রধান ক্লাবে’ একবার কেউ নাম লেখালে সেখান থেকে বের হওয়া কঠিন ছিল। মূলত এই রংমহলের আনঅফিসিয়াল নাম ছিল প্রধান ক্লাব।

দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, মূলত অনলাইনে ক্যাসিনো গেমের আসর বসিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন সেলিম প্রধান। শুধু এক মাসে তিনটি ব্যাংকের মাধ্যমে ৯ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। সব মিলিয়ে অনলাইনে জুয়া খেলার মাধ্যমে উত্তর কোরিয়া ও ফিলিপাইনে শতকোটি টাকার বেশি পাচার হয়েছে বলে মনে করছেন গোয়েন্দারা। প্রথমে পি-২৪ ও এসডি কনসাল্টিং অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট নামে দুটি অনলাইন জুয়ার প্রতিষ্ঠান খোলেন সেলিম প্রধান। পি-২৪-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন সেলিম মিয়া ওরফে ডন সেলিম প্রধান। একই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ছিলেন অন্য এক প্রভাবশালী ব্যক্তির ভাই। এসডি কনসাল্টিংয়ের চেয়ারম্যান করা হয় উত্তর কোরিয়ার নাগরিক মি. লিকে। আর ব্যবস্থাপনা পরিচালক করা হয়েছিল জনৈক গোলাম মাওলাকে। এসডি কনসাল্টিংয়ের নামে কমার্শিয়াল ব্যাংক অব সিলন ও সিটি ব্যাংকে তিনটি হিসাব খোলা ছিল। বিভিন্ন ইকোনমিক গেটওয়ের মাধ্যমে এই হিসাবগুলোতে লাখ লাখ টাকা জমা হতো; যা অনলাইন ক্যাসিনোর মাধ্যমে আয় হতো। একসময় সেলিম প্রধানের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয় গোলাম মাওলার। তাই টি-২১ নামে আরেকটি কোম্পানি খোলেন সেলিম প্রধান। ওই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান করা হয় রাজধানীর উত্তর বাড্ডার বাসিন্দা শাহনাজ পারভীন ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক করা হয় মুন্সীগঞ্জের বাসিন্দা জনৈক জাকির হোসেন পলাশকে। শাহনাজের গ্রামের বাড়ি জয়পুরহাটের পাঁচবিবিরহাট। তাদের বিস্তারিত পরিচয় তাৎক্ষণিকভাবে পাওয়া যায়নি। নেপথ্যে সেলিম প্রধানের হয়ে টি-২১ অনলাইন জুয়া খেলা পরিচালনা করতেন জনৈক আখতারুজ্জামান। তারা রাজধানীর বনানীতে একটি অফিস খুলে বসেন। ইউসিবি ব্যাংকের সামিট অ্যান্ড সবুর ব্রাদার্স নামে একটি প্রতিষ্ঠান ও যমুনা ব্যাংকের আলম গাজী নামে এক ব্যক্তির হিসাব নম্বরে তাদের অর্থ জমা হতো। অত্যন্ত চতুর ও ধূর্ত ছিলেন সেলিম প্রধান। নেপথ্যে থেকে অন্যদের ব্যবহার করেই অনলাইন ক্যাসিনোর মাধ্যমে টাকা পাচার করে আসছিলেন তিনি। তাকে এই কাজে সহযোগিতা করতেন চার কোরিয়ান। তারা হলেন- ডু, ইয়াং শি, লি ও জুনিয়ান লি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যবসায়ী জানান, এমন কোনো খারাপ দিক নেই যেটা ডন সেলিম মিয়ার ছিলো না। বিএনপি জামায়াত আমলে সেলিম প্রধানের সঙ্গে হাওয়া ভবনের অনেকের গভীর সম্পর্ক ছিল। সেলিমের বিয়ে নিয়েও রয়েছে নানা কাহিনী। একসময় রাশিয়ার আনা নামে এক নারীকে বিয়ে করেন সেলিম মিয়া। বর্তমানে জাপানেও তার এক স্ত্রী রয়েছে। পুরান ঢাকায় মাসুমা নামে এক নারীকেও বিয়ে করেন তিনি। তাকে নিয়েই গুলশানে থাকতেন তিনি। এ ছাড়া কাস্টমসে কর্মরত আরেক নারীকে সেলিম বিয়ে করেছেন বলে শোনা গেছে।

সেলিম তার সাঙ্গোপাঙ্গদের মাধ্যমে সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্টে গরু ও মাদক কারবারেও জড়িত ছিলেন বলে তথ্য পাওয়া গেছে। আন্তর্জাতিক জুয়াড়িদের সঙ্গে তার সখ্য রয়েছে। অনেক সময় সংসদ সদস্য লেখা সংবলিত স্টিকারযুক্ত গাড়ি নিয়ে চলতেন তিনি। সিলেটের পাথর ব্যবসায়ও তার নিয়ন্ত্রণ ছিল। সেলিম প্রধান রূপালী ব্যাংকের তালিকায় অন্যতম শীর্ষ ঋণখেলাপি। ব্যাংকটি বর্তমানে তার কাছে পাবে শতকোটি টাকার বেশি।

মতুর্জাবাদ এলাকার এক বাসিন্দা জানান, অনলাইন ক্যাসিনো ডন সেলিম প্রধান। অনেকের কাছে থাই ডন নামেই পরিচিতি সেলিম। চলাফেরা করেন কোটি টাকার ল্যান্ডক্রুজার গাড়িতে। সামনে পেছনে থাকে গাড়ির বহর। সঙ্গে থাকেন অস্ত্রধারী দেহরক্ষী। এমপি না হলেও গাড়ির সামনে সংসদ সদস্য স্টিকার থাকতো। যানজটে পড়লে উচ্চ শব্দে তার চালক বাজায় হুটার। ট্রাফিক পুলিশ শব্দ শুনে ভিআইপি ভেবে সিগন্যাল ছেড়ে দেয়। গাড়ি থেকে নামার সময় দরজা খুলে দেয় দেহরক্ষীরা। গাড়ি থেকে নামেনও ফিল্মি স্টাইলে। নামার সঙ্গে সঙ্গে তাকে ঘিরে রাখে দেহরক্ষীরা। রাজকীয় হালে চলা এই ক্যাসিনো ডনের জীবন যেন এক রূপকথা। শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়েতে থাকা একটি ফ্লাইট থেকে সেলিমকে আটকের পর গুলশান-২ নম্বরে তার বাসা এবং বনানীর একটি অফিসে দীর্ঘ ১৮ ঘণ্টা অভিযান চালায় র‌্যাব।

উদ্ধার করে প্রায় পৌনে ১ কোটি টাকা সমমূল্যের বিদেশি মুদ্রা, বাংলাদেশি মুদ্রায় ২৯ লাখ টাকা, দুটি হরিণের চামড়া ও বিপুল পরিমাণ মদের বোতল। আটক করে সেলিমের অন্যতম সহযোগী আক্তারুজ্জামান ও রোমান মিয়া নামে আরও দুজনকে। র‌্যাব বলেছেন, সেলিম মিয়া অনলাইন ক্যাসিনোর মাধ্যমে অর্জিত অর্থ নিয়মিত পাচার করতেন বিদেশে। একটি অংশ যেত লন্ডনের একটি ঠিকানায়।
তৎকালীন র‌্যাব-১ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল সারোয়ার বিন কাশেম বলেছেন, সেলিম প্রধান উত্তর কোরিয়ার নাগরিক মি. ইয়াংসিক লির সঙ্গে যৌথভাবে বাংলাদেশে অনলাইন ক্যাসিনো খুলে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন। আমরা এরই মধ্যে একটি গেটওয়েতে গত এক মাসে ৯ কোটি টাকা উত্তোলনের প্রমাণ পেয়েছি। তবে এই সিন্ডিকেটের আরও কোনো গেটওয়ে আছে কি না তা নিয়ে আমরা কাজ করছি। অনলাইন ক্যাসিনোর বিবরণ দিয়ে তিনি বলেন, এটা ভার্চুয়াল ক্যাসিনো। অনলাইনে টাকা দিয়ে এগুলো খেলতে হয়। নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা জমা রেখে মোবাইলে সফটওয়্যার ইনস্টল করার পর (পি-২৪) ভিসা, মাস্টার কার্ড, বিকাশে রাখা অর্থ দিয়ে অ্যাকাউন্ট খুলতে হবে। এটিতে অ্যাকাউন্ট খুলতে হয়। কেউ টাকা জিতলে নির্দিষ্ট অ্যাকাউন্টে টাকা আসবে। হারলে টাকাগুলো একটি গেটওয়ের মাধ্যমে তিনটি ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে যেত। সপ্তাহে একদিন সব টাকা এক ব্যাংকে দেওয়া হতো।
তিনি বলেন, আক্তারুজ্জামান তার গেমিং সাইটটি চালাত এবং টাকা সংগ্রহ করে অন্য ব্যাংকে জমা করত। এরপর কোরীয় নাগরিক এসে এই টাকাগুলো নিয়ে যেত। এটি সরাসরি মানি লন্ডারিং আইনের লঙ্ঘন। তাই তাকে চারটি অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে। প্রথমত মানি লন্ডারিং, মাদকদ্রব্য, ফরেন কারেন্সি অ্যাক্ট এবং বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনের লঙ্ঘন। গুলশানে সেলিম প্রধানের বাড়ি ও অফিসে অভিযানের বিষয়ে র‌্যাব অধিনায়ক বলেন, সেলিম মিয়া গিয়াসউদ্দিন আল মামুনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। তিনি মামুনকে একটি বিএমডব্লিউ গাড়িও উপহার দিয়েছিলেন বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন। এ ছাড়া সেলিম বিভিন্ন সময় লন্ডনে টাকা পাঠিয়েছেন বলে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। কয়েকটি সুনির্দিষ্ট অভিযোগে আমরা তাকে গ্রেফতার করেছি।
র‌্যাব-১ এর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সেলিম মিয়া জানিয়েছেন, ১৯৮৮ সালে ভাইয়ের মাধ্যমে জাপানে গিয়ে জাপানিদের সঙ্গে গাড়ির ব্যবসায় নিয়োজিত হন। পরে জাপানিদের সঙ্গে থাইল্যান্ড গিয়ে শিপ ব্রেকিং ব্যবসা করেন। পরে মি. দু নামের এক কোরীয় ব্যক্তি তাকে অনলাইন ক্যাসিনো খোলার উপদেশ দেন। এর ফলে তিনি ২০১৮ সালের পি-২৪ এবং টি-২১ হিসেবে দুটি গেমিং সাইট খোলেন। সেখান থেকে তিনি অনলাইন ক্যাসিনো পরিচালনা করতেন। তার কাগজপত্র যাচাই করে দেখা গেছে, ওই কোরীয় ও সেলিমের ৫০-৫০ অনুপাতে মুনাফা ভাগাভাগির চুক্তি হয়েছিল।

এদিকে সেলিম প্রধান সম্প্রতি রুপগঞ্জের একটি পূজা মন্ডপে দাঁড়িয়ে গণমাধ্যমের সামনে বলেছেন, ‘৪ বছর ১ দিন জেলে ছিলাম। ঠিক কত বছর পর রূপগঞ্জে ফিরলাম তা বলতে পারব না। আমার এলাকায় অনেক খারাপ কাজ হয়, ভালো কাজও হয়। এবার আমি বাকি জীবন রূপগঞ্জেই সময় দেব। এলাকাকে পরিবর্তন করে ছাড়ব। এটা আমার গ্যারান্টি। আমি রূপগঞ্জকে পরিবর্তন করেই ছাড়ব। আই এ্যাম বেক। এটাকে আমি পরিবর্তন করে ছাড়বো আই ডোন্ট কেয়ার এনি ওয়ান। তবে আমি পলিটিক্স করব না, এমপি নির্বাচনও করব না। পলিটিক্স করার ইচ্ছা আমার নেই। কিন্তু এলাকায় কোনো খারাপ কাজ হতে দেব না। পলিটিক্স ইজ এ জব। আমি চাই মানুষ যা চায় তা যেন পায়।

উল্লেখ্য: আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান চলাকালে ২০১৯ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর থাই এয়ারওয়েজের ফ্লাইটে ব্যাংকক যাওয়ার সময় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে সেলিম প্রধানকে আটক করে র‌্যাব-১। এরপর তার গুলশান, বনানীর বাসা ও অফিসে অভিযান চালিয়ে ২৯ লাখ টাকা, বিপুল বিদেশি মদ ও বিভিন্ন দেশের মুদ্রা জব্দ করা হয়। একই সঙ্গে উদ্ধার করা হয় হরিণের চামড়া। ওই দিনই বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনে ছয় মাসের কারাদন্ড দিয়ে সেলিম প্রধানকে কারাগারে পাঠান ভ্রাম্যমাণ আদালত।

সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করুন

ক্যাসিনো গুরু সেলিম মিয়াকে নিয়ে আলোচনার ঝড়

আপলোড সময় : ১২:২৬:২২ অপরাহ্ন, সোমবার, ৮ এপ্রিল ২০২৪

দেশের আলোচিত ক্যাসিনো সম্রাট সেলিম মিয়া ওরফে ডন সেলিম হঠাৎ নারায়ণগঞ্জের রুপগঞ্জকে মাদক ও সন্ত্রাসমুক্ত করার ঘোষনা দেওয়ায় তাকে নিয়ে আলোচনার ঝড় বইছে রুপগঞ্জসহ পুরো নারায়ণগঞ্জজুড়ে। যিনি নিজেই মাদক সম্রাট, ক্যাসিনো গুরু, থাই ডন, স্পা ব্যবসায়ী, চাঁদাবাজদের সর্দার হিসেবে দেশের গন্ডি পেরিয়ে বাইরে পরিচিতি পেয়েছেন তিনি কিভাবে রুপগঞ্জকে মাদক,সন্ত্রাসসহ বিভিন্ন অপরাধ মুক্ত করবেন এমন ঘোষনা দেওয়ায় রুপগঞ্জের পাড়া মহল্লায় তাকে নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় উঠেছে।

দেশ-বিদেশে অনলাইন জুয়া (ক্যাসিনো), স্পা ব্যবসা, সীমান্তের পশুর খাটালে চাঁদাবাজি, চোরাচালানসহ নানা অপকর্মের মূল হোতা এই সেলিম মিয়া ওরফে সেলিম প্রধান। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান চলাকালে ২০১৯ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর থাই এয়ারওয়েজের ফ্লাইটে ব্যাংকক যাওয়ার সময় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে সেলিম প্রধানকে আটক করে র‌্যাব-১। পরে গুলশান ও বনানীর বাসা, অফিসে অভিযান চালিয়ে ২৯ লাখ টাকা, বিপুল বিদেশি মদ ও বিভিন্ন দেশের মুদ্রা জব্দ করা হয়। একই সঙ্গে উদ্ধার করা হয় হরিণের চামড়া। ওই দিনই বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনে ছয় মাসের কারাদন্ড দিয়ে সেলিম প্রধানকে কারাগারে পাঠান ভ্রাম্যমাণ আদালত। দুদকের একটি মামলায় আট বছরের সাজা হয় সেলিম প্রধানের। এদিকে, হুট করে রূপগঞ্জে এই ক্যাসিনো সম্রাটের ফিরে আসাকে অশনি সংকেত বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।

অনুসন্ধান ও এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে জানাগেছে, উপজেলার গাউছিয়া মর্তুজাবাদ গ্রামে ১৯৭৩ সালে সেলিম প্রধানের জন্ম। বাবা ‘চাঁন মিয়া ও তার মায়ের নাম সফুরা খাতুন। ১২-১৩ বছর বয়সে ভাইয়ের সঙ্গে জাপান চলে যান তিনি। জাপানে গিয়ে অপরাধ জগতে জড়িয়ে পড়েন তিনি। সেখানে কে-১ ফাইটিং গ্রুপ তৈরি করেন। একসময় ‘জিরো ওয়াত্তা’ নামে এক জাপানি বক্সার ও আন্ডারওয়াল্ডের সদস্যের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক হয়। জাপানে পাসপোর্ট নিয়ে ঝামেলায় জড়িয়ে সেখানকার চিফ ইমিগ্রেশন কর্মকর্তাকে মারধর করেছিলেন সেলিম মিয়া। ওই ঘটনায় দায়ের করা মামলায় জাপানে জেলও খাটেন তিনি। এরপর জাপান থেকে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান সেলিম। সেখানে কিছু দিন থাকার পর দেশে ফেরেন। কিছুদিন পর আবার থাইল্যান্ড যান সেলিম। সেখানে তার একাধিক বাড়ি ও ব্যবসা রয়েছে। এক সময়ের সেলিম মিয়া এখন ডন সেলিম নামে সারাদেশে পরিচিত। তিনি এখন শত কোটি টাকার মালিক। এক যুগ আগেও সেলিম মিয়ার পরিচয় ছিলো শুধু গাউছিলার মর্তুজাবাদ এলাকার চাঁন মিয়ার ছেলে হিসেবে। সময়ের ব্যবধানে এখন তিনি ক্যাসিনো সম্রাট ডন সেলিম প্রধান নামে পরিচিত লাভ করেছেন। সেলিম প্রধানের পৈতৃক বাড়ি এমন জরাজীর্ণ থাকলেও গাউছিয়া থেকে অল্প দূরেই ভুলতা ফ্লাইওভারের শেষ মাথায় সাওঘাট এলাকায় সেলিম প্রধানের সেই আলোচিত ‘জাপান বাংলাদেশ সিকিউরিটি প্রিন্টিং অ্যান্ড পেপারস’ নামের বহুতল প্রতিষ্ঠান। যেখানে ছাপানো হয় বাংলাদেশের সব ব্যাংকের চেক বই, এফডিআরের মতো গুরুত্বপূর্ণ দলিলাদি।

জাপান থাকা অবস্থায় তার প্রিন্টিং প্রেসের ব্যবসা শুরু করেন। জাপানের টোকিওতেও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে কালো তালিকাভুক্ত হন তিনি। জাপান থেকে বহিষ্কার করা হলে তিনি আমেরিকায় চলে যান। সেখানে এক আমেরিকান নাগরিককে বিয়ে করে স্ত্রীকে কাজে লাগিয়ে ফের জাপানে ঢোকার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। তারপর দেশে ফিরে সেলিম প্রধান ওরফে সেলিম মিয়া বিএনপি-জামায়াত আমলে সখ্য গড়ে তোলেন তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু আলোচিত ব্যবসায়ী গিয়াস উদ্দিন আল মামুনের সঙ্গে। হয়ে যান তার ব্যবসায়িক পার্টনার। এলাকাবাসী সেলিম প্রধানকে বিএনপির স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা হিসেবে জানলেও তিনি কোনো পদে ছিলেন না।

সেলিম প্রধানের আপন চাচাতো ভাই আনোয়াদ সাদাত সায়েম জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি হয়েছেন সেলিম প্রধানের হাতের ইশারায়। আনোয়ার সাদাত সায়েম জাপান-বাংলাদেশ সিকিউরিটি প্রিন্টিংয়ের পরিচালক। সেলিম প্রধান যখন এলাকায় আসতেন সঙ্গে থাকত দামি গাড়িবহর, অস্ত্রধারী বডিগার্ড। দেশে ও বিদেশে ক্যাসিনোর পাশাপাশি স্পা ব্যবসা করা সেলিম নিয়মিত আসতেন তার প্রেসে। প্রেসের ভিতরে রয়েছে তার বালাখানা। গভীর রাতে সেলিম মিয়া এখানে আসতেন ঘনিষ্ঠদের নিয়ে। বিদেশি নাগরিকদেরও নিয়ে আসতেন। সঙ্গে থাকতেন সুন্দরী ললনারা। ভোর পর্যন্ত চলত মদ্যপান, হৈহুল্লোড়। র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার হয়েছিলেন সেলিম মিয়া। ব্যাংককের পাতায়ায় তার বিলাসবহুল হোটেল, ডিসকো বারসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। শুধু অনলাইন ক্যাসিনো পরিচালনাই নয়, সেলিম রাজশাহীসহ সীমান্ত এলাকায় ভারতীয় গবাদিপশুর সব খাটাল ও মাদক সিন্ডিকেটের হোতা। এমনকি সীমান্তে জাল টাকার মূল সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণও তার হাতে। গুলশান ২-এর ৯৯ নম্বর সড়কের ১১/১ নম্বর বাসার একটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট ভাড়া করে ‘রংমহল’ বানিয়েছিলেন আন্ডারওয়ার্ল্ডে ‘থাই ডন’ হিসেবে পরিচিত সেলিম প্রধান। সপ্তাহের প্রতি শনিবার বিকেল সাড়ে ৩টা থেকে সারারাত সেখানে ‘জলসা’ হতো। সেই জলসায় যাতায়াত ছিল একাধিক প্রভাবশালী রাজনীতিক, শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারও। জলসায় অংশগ্রহণকারীদের অনৈতিক ও অসংযত জীবনাচরণের ছবি ধারণ করতে বসানো ছিল গোপন ক্যামেরা। সেই ক্যামেরায় ধারণ করা ভিডিও মেমোরি কার্ডে নিয়ে রাখতেন সেলিম মিয়া। পরে ওই ছবি দেখিয়ে ভিআইপিদের ফাঁসানোর ফাঁদ পাততেন তিনি। সেলিমের ঘনিষ্ঠজন ছাড়াও একাধিক দায়িত্বশীল গোয়েন্দা সূত্র থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। র‌্যাবের হাতে গ্রেফতারের পর সেলিম প্রধানের অপরাধ জগতের অনেক চমকপ্রদ তথ্য বেরিয়ে এসেছে।

গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, আন্ডারওয়াল্ডের ডন সেলিম প্রধান ২০১৯ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর থাই এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইটে বিদেশ যাওয়ার সময় তার লাগেজের সঙ্গে অনেক মালপত্র নিয়ে যাচ্ছিলেন। লাগেজ তল্লাশি করে পাওয়া যায় তিনটি মেমোরি কার্ড। পরে ওই কার্ড পরীক্ষা করে দেখা যায়, সেখানে রয়েছে দেশি-বিদেশি তরুণীদের সঙ্গে অনেক ভিআইপির অন্তরঙ্গ ছবি। জিজ্ঞাসাবাদে জানতে চাওয়া হয়, কেন ওই মেমোরি কার্ড থাইল্যান্ডে নিয়ে যাচ্ছিলেন- এ প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি সেলিম মিয়া। তবে গোয়েন্দারা বলেছেন, এসব ভিডিও দেখিয়ে ফাঁসানোর ভয় দেখিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা ছিল সেলিম প্রধানের। বিদেশে বসে ভিআইপিদের গোপন ভিডিও প্রচার ও প্রকাশের কথা বলে টাকা হাতিয়ে নেওয়াই ছিল তার মূল উদ্দেশ্য।

গোয়েন্দারা বলছেন, সেলিম প্রধান একজন বহুরূপী প্রতারক। সমাজের উচ্চবিত্ত শ্রেণির সঙ্গে তার গভীর সখ্য ছিল। অনেক সময় বড় বড় প্রতিষ্ঠান কোনো আইনি ঝামেলায় পড়লে প্রভাবশালীদের ব্যবহার করে তা মিটমাট করে দেওয়ার বিনিময়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়েছেন তিনি। তবে যারা তার রংমহলে নিয়মিত যেতেন তারা কোনোভাবে টের পাননি গোপনে তার ছবি ধারণ করে রাখা হচ্ছে।
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি সংস্থা সেলিমের সহকারী মাসুমকে জিজ্ঞাসাবাদ করায় বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য মিলেছে। তিনি সেলিমের রংমহলের অনেক তথ্য দিয়েছেন। গুলশানে সেলিমের বাসা থেকে অসামাজিক কাজে ব্যবহার হতো, এরকম অনেক আলামত পাওয়া গেছে। মাসুম জানান, সেলিমের নির্দেশে বায়তুল মোকাররম মার্কেট থেকে গোপন ক্যামেরা কিনে গুলশানের বাসায় লাগানো হয়। গোপনে ভিআইপিদের ছবি ধারণ করার দায় সেলিম প্রধানের। গুলশানে তার রংমহলে যারা নিয়মিত যেতেন তাদের ‘প্রধান ক্লাবের’ সদস্য করে নিতেন সেলিম। ‘প্রধান ক্লাবে’ একবার কেউ নাম লেখালে সেখান থেকে বের হওয়া কঠিন ছিল। মূলত এই রংমহলের আনঅফিসিয়াল নাম ছিল প্রধান ক্লাব।

দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, মূলত অনলাইনে ক্যাসিনো গেমের আসর বসিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন সেলিম প্রধান। শুধু এক মাসে তিনটি ব্যাংকের মাধ্যমে ৯ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। সব মিলিয়ে অনলাইনে জুয়া খেলার মাধ্যমে উত্তর কোরিয়া ও ফিলিপাইনে শতকোটি টাকার বেশি পাচার হয়েছে বলে মনে করছেন গোয়েন্দারা। প্রথমে পি-২৪ ও এসডি কনসাল্টিং অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট নামে দুটি অনলাইন জুয়ার প্রতিষ্ঠান খোলেন সেলিম প্রধান। পি-২৪-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন সেলিম মিয়া ওরফে ডন সেলিম প্রধান। একই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ছিলেন অন্য এক প্রভাবশালী ব্যক্তির ভাই। এসডি কনসাল্টিংয়ের চেয়ারম্যান করা হয় উত্তর কোরিয়ার নাগরিক মি. লিকে। আর ব্যবস্থাপনা পরিচালক করা হয়েছিল জনৈক গোলাম মাওলাকে। এসডি কনসাল্টিংয়ের নামে কমার্শিয়াল ব্যাংক অব সিলন ও সিটি ব্যাংকে তিনটি হিসাব খোলা ছিল। বিভিন্ন ইকোনমিক গেটওয়ের মাধ্যমে এই হিসাবগুলোতে লাখ লাখ টাকা জমা হতো; যা অনলাইন ক্যাসিনোর মাধ্যমে আয় হতো। একসময় সেলিম প্রধানের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয় গোলাম মাওলার। তাই টি-২১ নামে আরেকটি কোম্পানি খোলেন সেলিম প্রধান। ওই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান করা হয় রাজধানীর উত্তর বাড্ডার বাসিন্দা শাহনাজ পারভীন ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক করা হয় মুন্সীগঞ্জের বাসিন্দা জনৈক জাকির হোসেন পলাশকে। শাহনাজের গ্রামের বাড়ি জয়পুরহাটের পাঁচবিবিরহাট। তাদের বিস্তারিত পরিচয় তাৎক্ষণিকভাবে পাওয়া যায়নি। নেপথ্যে সেলিম প্রধানের হয়ে টি-২১ অনলাইন জুয়া খেলা পরিচালনা করতেন জনৈক আখতারুজ্জামান। তারা রাজধানীর বনানীতে একটি অফিস খুলে বসেন। ইউসিবি ব্যাংকের সামিট অ্যান্ড সবুর ব্রাদার্স নামে একটি প্রতিষ্ঠান ও যমুনা ব্যাংকের আলম গাজী নামে এক ব্যক্তির হিসাব নম্বরে তাদের অর্থ জমা হতো। অত্যন্ত চতুর ও ধূর্ত ছিলেন সেলিম প্রধান। নেপথ্যে থেকে অন্যদের ব্যবহার করেই অনলাইন ক্যাসিনোর মাধ্যমে টাকা পাচার করে আসছিলেন তিনি। তাকে এই কাজে সহযোগিতা করতেন চার কোরিয়ান। তারা হলেন- ডু, ইয়াং শি, লি ও জুনিয়ান লি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যবসায়ী জানান, এমন কোনো খারাপ দিক নেই যেটা ডন সেলিম মিয়ার ছিলো না। বিএনপি জামায়াত আমলে সেলিম প্রধানের সঙ্গে হাওয়া ভবনের অনেকের গভীর সম্পর্ক ছিল। সেলিমের বিয়ে নিয়েও রয়েছে নানা কাহিনী। একসময় রাশিয়ার আনা নামে এক নারীকে বিয়ে করেন সেলিম মিয়া। বর্তমানে জাপানেও তার এক স্ত্রী রয়েছে। পুরান ঢাকায় মাসুমা নামে এক নারীকেও বিয়ে করেন তিনি। তাকে নিয়েই গুলশানে থাকতেন তিনি। এ ছাড়া কাস্টমসে কর্মরত আরেক নারীকে সেলিম বিয়ে করেছেন বলে শোনা গেছে।

সেলিম তার সাঙ্গোপাঙ্গদের মাধ্যমে সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্টে গরু ও মাদক কারবারেও জড়িত ছিলেন বলে তথ্য পাওয়া গেছে। আন্তর্জাতিক জুয়াড়িদের সঙ্গে তার সখ্য রয়েছে। অনেক সময় সংসদ সদস্য লেখা সংবলিত স্টিকারযুক্ত গাড়ি নিয়ে চলতেন তিনি। সিলেটের পাথর ব্যবসায়ও তার নিয়ন্ত্রণ ছিল। সেলিম প্রধান রূপালী ব্যাংকের তালিকায় অন্যতম শীর্ষ ঋণখেলাপি। ব্যাংকটি বর্তমানে তার কাছে পাবে শতকোটি টাকার বেশি।

মতুর্জাবাদ এলাকার এক বাসিন্দা জানান, অনলাইন ক্যাসিনো ডন সেলিম প্রধান। অনেকের কাছে থাই ডন নামেই পরিচিতি সেলিম। চলাফেরা করেন কোটি টাকার ল্যান্ডক্রুজার গাড়িতে। সামনে পেছনে থাকে গাড়ির বহর। সঙ্গে থাকেন অস্ত্রধারী দেহরক্ষী। এমপি না হলেও গাড়ির সামনে সংসদ সদস্য স্টিকার থাকতো। যানজটে পড়লে উচ্চ শব্দে তার চালক বাজায় হুটার। ট্রাফিক পুলিশ শব্দ শুনে ভিআইপি ভেবে সিগন্যাল ছেড়ে দেয়। গাড়ি থেকে নামার সময় দরজা খুলে দেয় দেহরক্ষীরা। গাড়ি থেকে নামেনও ফিল্মি স্টাইলে। নামার সঙ্গে সঙ্গে তাকে ঘিরে রাখে দেহরক্ষীরা। রাজকীয় হালে চলা এই ক্যাসিনো ডনের জীবন যেন এক রূপকথা। শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়েতে থাকা একটি ফ্লাইট থেকে সেলিমকে আটকের পর গুলশান-২ নম্বরে তার বাসা এবং বনানীর একটি অফিসে দীর্ঘ ১৮ ঘণ্টা অভিযান চালায় র‌্যাব।

উদ্ধার করে প্রায় পৌনে ১ কোটি টাকা সমমূল্যের বিদেশি মুদ্রা, বাংলাদেশি মুদ্রায় ২৯ লাখ টাকা, দুটি হরিণের চামড়া ও বিপুল পরিমাণ মদের বোতল। আটক করে সেলিমের অন্যতম সহযোগী আক্তারুজ্জামান ও রোমান মিয়া নামে আরও দুজনকে। র‌্যাব বলেছেন, সেলিম মিয়া অনলাইন ক্যাসিনোর মাধ্যমে অর্জিত অর্থ নিয়মিত পাচার করতেন বিদেশে। একটি অংশ যেত লন্ডনের একটি ঠিকানায়।
তৎকালীন র‌্যাব-১ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল সারোয়ার বিন কাশেম বলেছেন, সেলিম প্রধান উত্তর কোরিয়ার নাগরিক মি. ইয়াংসিক লির সঙ্গে যৌথভাবে বাংলাদেশে অনলাইন ক্যাসিনো খুলে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন। আমরা এরই মধ্যে একটি গেটওয়েতে গত এক মাসে ৯ কোটি টাকা উত্তোলনের প্রমাণ পেয়েছি। তবে এই সিন্ডিকেটের আরও কোনো গেটওয়ে আছে কি না তা নিয়ে আমরা কাজ করছি। অনলাইন ক্যাসিনোর বিবরণ দিয়ে তিনি বলেন, এটা ভার্চুয়াল ক্যাসিনো। অনলাইনে টাকা দিয়ে এগুলো খেলতে হয়। নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা জমা রেখে মোবাইলে সফটওয়্যার ইনস্টল করার পর (পি-২৪) ভিসা, মাস্টার কার্ড, বিকাশে রাখা অর্থ দিয়ে অ্যাকাউন্ট খুলতে হবে। এটিতে অ্যাকাউন্ট খুলতে হয়। কেউ টাকা জিতলে নির্দিষ্ট অ্যাকাউন্টে টাকা আসবে। হারলে টাকাগুলো একটি গেটওয়ের মাধ্যমে তিনটি ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে যেত। সপ্তাহে একদিন সব টাকা এক ব্যাংকে দেওয়া হতো।
তিনি বলেন, আক্তারুজ্জামান তার গেমিং সাইটটি চালাত এবং টাকা সংগ্রহ করে অন্য ব্যাংকে জমা করত। এরপর কোরীয় নাগরিক এসে এই টাকাগুলো নিয়ে যেত। এটি সরাসরি মানি লন্ডারিং আইনের লঙ্ঘন। তাই তাকে চারটি অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে। প্রথমত মানি লন্ডারিং, মাদকদ্রব্য, ফরেন কারেন্সি অ্যাক্ট এবং বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনের লঙ্ঘন। গুলশানে সেলিম প্রধানের বাড়ি ও অফিসে অভিযানের বিষয়ে র‌্যাব অধিনায়ক বলেন, সেলিম মিয়া গিয়াসউদ্দিন আল মামুনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। তিনি মামুনকে একটি বিএমডব্লিউ গাড়িও উপহার দিয়েছিলেন বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন। এ ছাড়া সেলিম বিভিন্ন সময় লন্ডনে টাকা পাঠিয়েছেন বলে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। কয়েকটি সুনির্দিষ্ট অভিযোগে আমরা তাকে গ্রেফতার করেছি।
র‌্যাব-১ এর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সেলিম মিয়া জানিয়েছেন, ১৯৮৮ সালে ভাইয়ের মাধ্যমে জাপানে গিয়ে জাপানিদের সঙ্গে গাড়ির ব্যবসায় নিয়োজিত হন। পরে জাপানিদের সঙ্গে থাইল্যান্ড গিয়ে শিপ ব্রেকিং ব্যবসা করেন। পরে মি. দু নামের এক কোরীয় ব্যক্তি তাকে অনলাইন ক্যাসিনো খোলার উপদেশ দেন। এর ফলে তিনি ২০১৮ সালের পি-২৪ এবং টি-২১ হিসেবে দুটি গেমিং সাইট খোলেন। সেখান থেকে তিনি অনলাইন ক্যাসিনো পরিচালনা করতেন। তার কাগজপত্র যাচাই করে দেখা গেছে, ওই কোরীয় ও সেলিমের ৫০-৫০ অনুপাতে মুনাফা ভাগাভাগির চুক্তি হয়েছিল।

এদিকে সেলিম প্রধান সম্প্রতি রুপগঞ্জের একটি পূজা মন্ডপে দাঁড়িয়ে গণমাধ্যমের সামনে বলেছেন, ‘৪ বছর ১ দিন জেলে ছিলাম। ঠিক কত বছর পর রূপগঞ্জে ফিরলাম তা বলতে পারব না। আমার এলাকায় অনেক খারাপ কাজ হয়, ভালো কাজও হয়। এবার আমি বাকি জীবন রূপগঞ্জেই সময় দেব। এলাকাকে পরিবর্তন করে ছাড়ব। এটা আমার গ্যারান্টি। আমি রূপগঞ্জকে পরিবর্তন করেই ছাড়ব। আই এ্যাম বেক। এটাকে আমি পরিবর্তন করে ছাড়বো আই ডোন্ট কেয়ার এনি ওয়ান। তবে আমি পলিটিক্স করব না, এমপি নির্বাচনও করব না। পলিটিক্স করার ইচ্ছা আমার নেই। কিন্তু এলাকায় কোনো খারাপ কাজ হতে দেব না। পলিটিক্স ইজ এ জব। আমি চাই মানুষ যা চায় তা যেন পায়।

উল্লেখ্য: আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান চলাকালে ২০১৯ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর থাই এয়ারওয়েজের ফ্লাইটে ব্যাংকক যাওয়ার সময় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে সেলিম প্রধানকে আটক করে র‌্যাব-১। এরপর তার গুলশান, বনানীর বাসা ও অফিসে অভিযান চালিয়ে ২৯ লাখ টাকা, বিপুল বিদেশি মদ ও বিভিন্ন দেশের মুদ্রা জব্দ করা হয়। একই সঙ্গে উদ্ধার করা হয় হরিণের চামড়া। ওই দিনই বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনে ছয় মাসের কারাদন্ড দিয়ে সেলিম প্রধানকে কারাগারে পাঠান ভ্রাম্যমাণ আদালত।

সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করুন