জাতিসংঘের বিবৃতিতে বিভ্রান্তিকর তথ্য!
- আপলোড সময় : ০১:০৫:২১ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২ নভেম্বর ২০২৩
- / ৬১১ বার পড়া হয়েছে
বিএনপি-জামায়াতের সহিংসতা বিষয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে বিবৃতি দিয়েছে জাতিসংঘের হাইকমিশনারের দপ্তর (ওএইচসিএইচআর)। গত ৩১ অক্টোবর সকালে প্রকাশিত সংস্থাটির বিবৃতিতে বাংলাদেশে চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। বিবৃতিতে ওইদিন সকাল পর্যন্ত ১১ জনের মৃত্যুর তথ্য দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেদিন সকাল পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা ছিল পাঁচজন। নয়াপল্টনে বিএনপির ডাকা মহাসমাবেশ কাভার করতে গিয়ে ৩০ জনের মতো সাংবাদিক আহত হয়েছেন। আহত সাংবাদিকদের অধিকাংশই বিএনপি কর্মীদের মারধরের শিকার হন। আর কয়েকজন পুলিশ ও বিএনপি কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষে পড়ে আহত হন। কিন্তু জাতিসংঘের হাইকমিশনারের দেওয়া বিবৃতিতে বলা হয়, সরকারি দলের মুখোশধারী কর্মীরা পৃথক মোটরসাইকেলে করে এসে সাংবাদিকদের মারধর করেছে বলে ধারণা করছে সংস্থাটি। জাতিসংঘের হাইকমিশনারের দপ্তরের বিবৃতিকে ত্রুটিপূর্ণ বলে ধারণা করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন। তিনি জানিয়েছেন, বিবৃতির মাধ্যমে প্রতিবাদ জানাবে সরকার।
বুধবার (১ নভেম্বর) রাতে এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ওএইচসিএইচআরের ওই বিবৃতির প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এতে সরকার বলেছে, জাতিসংঘের হাইকমিশনারের কার্যালয় বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার সুরক্ষিত করার জন্য সদস্য রাষ্ট্রগুলোর ম্যান্ডেটপ্রাপ্ত। এ সংস্থার কার্যক্রম অবশ্যই বস্তুনিষ্ঠতা, নিরপেক্ষতা এবং সবার ক্ষেত্রে একই নীতির প্রতিফলন ঘটায়। এই পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের পরামর্শ হলোÑ প্রকাশের আগে যথাযথভাবে তথ্য সংগ্রহ, যাচাই-বাছাই ও পর্যালোচনা করতে হবে। বাংলাদেশ সরকার আশা করে, প্রকৃত ঘটনার ওপর ভিত্তি করে বিবৃতি সংশোধন করবে ওএইচসিএইচআর।
প্রতিক্রিয়ায় জাতিসংঘের হাইকমিশনারের দপ্তরের উল্লেখ করা বিভ্রান্তিমূলক তথ্যের ব্যাখ্যাও দিয়েছে বাংলাদেশ। এতে বলা হয়েছে, অসংখ্য ছবি এবং ভিডিওতে দেখা গেছে, ওইদিন কয়েক ডজন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যের ওপর হামলা করা হয়েছিল, তাদের আহত করা হয়েছিল, প্রকাশ্যে সড়কে পুলিশের একজন সদস্যকে নির্দয়ভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছিল, বাসের হেলপারকে জীবন্ত পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। এ ছাড়া বাস, ফায়ার সার্ভিসের গাড়িসহ অন্যান্য গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়, প্রধান বিচারপতি ও দেশের সর্বোচ্চ আদালতের অন্য বিচারকদের বাসভবন ভাঙচুর করা হয়, পুলিশ হাসপাতাল চত্বর ও অ্যাম্বুলেন্সে আগুন দেওয়া হয় এবং বেশ কয়েকটি থানা ভাঙচুর করা হয়, সাংবাদিক ও ক্যামেরা-কর্মীদের ওপর হামলা করা হয়। এমনকি বিএনপির এমন ক্রমাগত নৃশংসতার মুখেও বাংলাদেশ সরকার এবং এর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অত্যন্ত সংযম ও ধৈর্য প্রদর্শন করেছে এবং জনশৃঙ্খলা নিশ্চিত করতে সর্বনিম্ন ও সর্বোত্তম শক্তি প্রয়োগ করেছে।
প্রতিক্রিয়ায় আরও বলা হয়, মোটরসাইকেল চড়া ‘মুখোশধারী ব্যক্তিদের’ ক্ষমতাসীন দলের সমর্থক ‘চিন্তা করা হয়েছে’Ñ বাংলাদেশ সরকার এমন যেকোনো ইঙ্গিত প্রত্যাখ্যান করে। ব্যাপক প্রচারিত ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, বিএনপির সমাবেশ থেকে সাংবাদিকদের ওপর হামলা, প্রধান বিচারপতির বাসভবন ভাঙচুর করা হয়েছে। মিডিয়া রিপোর্টে একজন ব্যক্তিকে প্রতিরক্ষামূলক পোশাক পরা এবং আইন প্রয়োগকারী এজেন্ট/প্রেস কর্মী হিসেবে নিজেকে জাহির করে এবং যানবাহনে আগুন লাগিয়ে যুবদলের (বিএনপির যুব শাখা) ঢাকা শহর দক্ষিণ শাখার সদস্য সচিব রবিউল ইসলাম নয়নকে শনাক্ত করেছে। আহত সাংবাদিকরা দাবি করেননি যে, তাদের ওপর ক্ষমতাসীন দলের সদস্যরা হামলা করেছে। গত ২৮ অক্টোবর বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে সাংবাদিকদের ওপর বিএনপি কর্মীদের হামলার নিন্দা জানানো হয়েছে।
সরকারের বিজ্ঞপ্তিতে আরও জানানো হয়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বিভ্রান্ত করতে এবং এভাবে সহানুভূতি অর্জনের জন্য বিএনপি ভুল তথ্যের আশ্রয় নিয়েছে। বিএনপি কার্যালয়ের এক সংবাদ সম্মেলনে একজনকে ‘মার্কিন প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা’ পরিচয় দেওয়া হয়। জাতিকে সন্ত্রস্ত করা এবং বাংলাদেশের জনগণ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বিভ্রান্ত করার পেছনে বিএনপির উদ্দেশ্য হচ্ছে আগামী নির্বাচন ও সাংবিধানিক প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করা। ওএইচসিএইচআর হয়তো বিএনপির ভুল তথ্যের প্রচারণার খপ্পরে পড়ে গেছে বলেও প্রতিক্রিয়ায় উল্লেখ করেছে বাংলাদেশ সরকার।
এর আগে গতকাল পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন সাংবাদিকদের বলেন, জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তরের বিবৃতিতে তথ্যগত গ্যাপ রয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে ওই বিবৃতির প্রতিবাদ পাঠানো হবে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ওএইচসিএইচআরের অনেক বর্ণনা বেশ ত্রুটিপূর্ণ। আসল ঘটনা বিবর্জিত। এ রকম প্রতিষ্ঠানের তথ্যে গ্যাপ থাকাটা খুবই দুঃখজনক। আমরা সে বিষয়ে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করব। আর তাদের বর্ণনায় যে ভুলগুলো আছে, সেগুলো তুলে ধরব।
জাতীয় পত্রিকার সম্পাদকদের সঙ্গে এক মতবিনিময়ে তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদও গতকাল ওএইচসিএইচআরের এই বিবৃতির নিন্দা জানান। এসময় তিনি সম্পাদকদের অনুরোধ জানানÑ এই ভুল তথ্যের জন্য আপনারাও প্রতিবাদ জানান।
জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ও ভোরের কাগজ পত্রিকার সম্পাদক শ্যামল দত্ত এ ব্যাপারে প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, জাতিসংঘের হাইকমিশনারের দপ্তরের বিবৃতি মিথ্যা তথ্য ও ভুলে ভরা। সাংবাদিকদের ওপর হামলার জন্য ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকদের প্রতি ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছেÑ এটি নিন্দনীয়। আহত সাংবাদিকরা বলেছেন, বিএনপি কর্মীরা হামলা করেছে। সুতরাং জাতিসংঘের এ ধরনের একটি সংস্থার কাছে এমন মিথ্যাচার কেউ আশা করে না। নিহতদের তথ্যেও ভুল রয়েছে। স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা নিহত হয়েছে, সেটি উল্লেখ করা হয়নি। আর যেদিন বিবৃতি দেওয়া হয়েছে, ওইদিন সকাল পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা ছিল ৫ জন। সুতরাং এটি মিথ্যা তথ্য।’
সাংবাদিক সংগঠনের পক্ষ থেকেও ওই বিবৃতির প্রতিবাদ জানানো হবে উল্লেখ করে শ্যামল দত্ত বলেন, ‘বিবৃতিটি দেখে মনে হয়, বিএনপি-জামায়াত ও তাদের জোটসঙ্গী কারও কাছ থেকে তথ্য পেয়ে সেটি হুবহু প্রকাশ করা হয়েছে।’
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তরের (ওএইচসিএইচআর) বিবৃতিতে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশে চলমান বিক্ষোভের মধ্যে একের পর এক সহিংসতার ঘটনায় আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। দেশটিতে সামনে জাতীয় নির্বাচন থাকায় আমরা রাজনৈতিক সব পক্ষের প্রতি এটা স্পষ্ট করার আহ্বান জানাচ্ছি যে, এমন সহিংসতা গ্রহণযোগ্য নয়। সেই সঙ্গে সহিংসতা উস্কে দেয়Ñ এমন বক্তব্য ও তৎপরতা থেকে বিরত থাকতেও আমরা রাজনীতিকদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।
বিবৃতিতে আরও উল্লেখ করা হয়, আজ সকাল পর্যন্ত (৩১ অক্টোবর), বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভের সঙ্গে জড়িত কমপক্ষে ১১ জনের মৃত্যু হয়েছে। নিহতদের মধ্যে দুই পুলিশ সদস্য, ছয়জন বিরোধী দলের কর্মী এবং দুজন পথচারী রয়েছেন। ২৮ অক্টোবর সরকারবিরোধী বিক্ষোভকারীরা প্রধান বিচারপতিসহ অন্য বিচারকদের বাসভবনে হামলা করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া সেদিন আনুমানিক ৩০ সাংবাদিকের ওপর হামলা করা হয়েছে। এসব হামলায় বিক্ষোভকারীরা ছাড়াও মোটরসাইকেলে আসা মুখোশ পরা একদল ব্যক্তি যুক্ত ছিলেন, যারা ক্ষমতাসীন দলের সমর্থক বলে ধারণা করা হচ্ছে।
জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তর বলছে, পুলিশ রড, লাঠি, রাবার বুলেট ও সাউন্ড গ্রেনেড দিয়ে বিক্ষোভকারীদের ওপর আক্রমণ করেছে বলে খবর রয়েছে। এ ছাড়া তারা দেশজুড়ে বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের বাড়িতে তল্লাশি, নির্বিচার আটক এবং নেতাকর্মীদের পরিবারের সদস্যসহ শত শত ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে।
কেবল জরুরি প্রয়োজন হলেই যেন শক্তি প্রয়োগ করা হয়, তা নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশ পুলিশের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে বিবৃতিতে। বলা হয়েছে, সেটি করা হলে যেন আইনের মূলনীতি, পূর্ব সতর্কতা এবং ন্যায্যতার ভিত্তিতে করা হয়।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে গ্রেপ্তারের কথা উল্লেখ করে ওএইচসিএইচআর বলেছে, প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলার ঘটনায় তার বিরুদ্ধে বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে অভিযোগ আনা হয়েছে। তাকে কারাবন্দি করে রাখা হয়েছে। গ্রেপ্তার আতঙ্কে বেশ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ বিরোধীদলীয় নেতা আত্মগোপনে গেছেন বলেও খবর রয়েছে।